জীবনের গল্প

অফিস থেকে ফেরার পথে বাজার করে শিনিতা — নানা পদের সবজি আর কিছু মসলা। তিন তিনটা ভারী ব্যাগ নিয়ে বাসায় ফিরছে সে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেক আগেই। কাজের খালা মনে হয় এতক্ষণ এসে ফিরে গিয়েছে। গেট খুলে ছয় তলায় নিজের বাসার দিকে পা বাড়ায়।

লিফট নেই এই বাসাটায়। থাকবেই বা কি করে? লিফটসহ বাসা গুলোর যে আকাশচুম্বী ভাড়া! কপাল থেকে ঘাম চুইয়ে পড়ছে, কিন্তু হাত খালি নেই যে ঘামটা মুছবে! খুব নিঃসঙ্গ লাগতে থাকে শিনিতার। কিন্তু কী করবে?

হাসানের উপর রাগ হয় না তার। বেচারার কী দোষ? চাকরী বাঁচাতে এবং জীবন সাজাতে মাঝরাত পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয় ওকে –সেটা তো ওর দোষ না।

এসব ভাবতে ভাবতেই বাসার দরজা খুলে শিনিতা। বাজারের ব্যাগগুলো নামিয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নেয় সে। খালা আসেনি, তাই নিজেরই রান্না করতে হবে। যদিও খালা থাকলেও নিজের রান্না নিজেই করতে ভালোবাসে সে। স্টুডেন্ট লাইফের অভ্যাস।

কিন্তু রান্নাঘরে ঢোকার আগে অ্যাসাইনমেন্টটা পাঠাতে হবে বসের কাছে। না হলে চাকরীটা নিয়ে আবার না টানাটানি লাগে! অফিসে তো বসের কাছে কানপড়া দেবার লোকের অভাব নেই। এসব ভাবলে মাঝে মাঝে মনে হয় কেন বিসিএস এর জন্য চেষ্টা করল না। কিন্তু পরক্ষণেই উপলব্ধি করল, সরকারী চাকরী পাবার মেধা থাকলেও তা করবার মত রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক যোগ্যতা কোনটাই তার নেই।

ফ্রিজ খুলে নিজের হাতে বানানো মধু, শসা আর লেবুর রসের ঠাণ্ডা ফেসপ্যাকটা মুখে লাগিয়ে কিছুটা শান্তি অনুভব করে সে। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে জীবন-যাপন করা এক মধ্যবিত্ত বাঙালি বধূর কি সাধ্য আছে প্রতিমাসে পারসোনায় গিয়ে গোল্ড ফেসিয়াল করার? তাই রূপচর্চার জন্য এই ব্যবস্থা।

ড্রাই কেকের প্যাকেটটা খুলে খেতে খেতে শিনিতা বসে যায় ল্যাপটপ নিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট করতে। আর ভাবতে থাকে জীবনটা বড় কঠিন। ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে দু’ফোটা অশ্রুও জমে ওঠে। এসময় হাসান থাকলে চোখের জলটা মুছে দিত।

যাই হোক, এসব নিয়ে মন খারাপ করে না সে। বরং কঠিন প্রতিযোগিতা আর দুর্নীতির যুগে এবং দেশে হালাল খেয়ে-পরে নিজেদের সংসার নিজেরা চালাতে পারছে, এজন্য সে সবসময় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে শুকরিয়া আদায় করে।

শিনিতা ওরকম মেয়ে নয় যারা গাড়ি-বাড়ি-শাড়ি-গহনার নিচে চাপা পড়ে তার রবকে ভুলে থাকে। অথবা বছর বছর কক্সবাজার বা থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুর যেতে না পারার জন্য ফেসবুকে তার কলিগদের বিদেশ ট্যুরের ছবি দেখে হা-হুতাশ করবে। শিনিতার জীবনের লক্ষ্য একটাই — হাসানকে নিয়ে, দুজনের পরিবার নিয়ে হালাল রিজিকের উপর বেঁচে থাকা এবং ঈমান সহকারে তার রবের সাথে দেখা করা।

তবে হ্যাঁ, নরম-কোমল রেশমের কাপড় পরার এবং দামী অট্টালিকাসম বাড়ির সামনের টিউলিপের বাগানে সেগুন কাঠের সোফায় হেলান দিয়ে মুখোমুখি বসে হাসানের সাথে ঠাণ্ডা কচি ডাবের পানি খাবার স্বপ্ন সে ও দেখে। কিন্তু সেই স্বপ্ন এই ঠুনকো দুনিয়ার জন্য নয়, যা ৫০-৬০ বছরেই শেষ হয়ে যায়।

শিনিতা এই স্বপ্ন দেখে এমন এক জগতের জন্য, যে জগত অন্তহীন। যে জগতের আলো মানুষের চোখের লেন্স দিয়ে প্রতিসরিত হয় না, যে জগতের ছবি মানুষের রেটিনা আঁকতে পারে না।

সেই জগতের নাম জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত হয় নহরসমূহ।

…………………
জীবনের গল্প
ডাঃ ঈপসিতা ইভা

জুলাই ০৩, ২০১৮ইং