দেশে গেলে টাকা খরচ

সেদিন সন্ধ্যায় এক ভাই আসলেন বাসায় উনার কিছু কাজে। কথা প্রসংগে বললেন, উনার কিছু জায়গা খালি পরে আছে, সেগুলোতে যদি উনি কোন স্থাপনা না করেন, তাহলে তো সেই জায়গার অপচয় হবে, আর অপচয় করা তো গুনাহ! আমি শুনে প্রথমবার একটু অবাকই হলাম। এই প্রথম কারো থেকে এমন লজিক শুনলাম তো, তাই হয়তো।

কিন্তু ভেবে দেখার মত বিষয় হচ্ছে, শয়তান কত ভাবেই না আমাদের ফাঁদে ফেলে!!! অপচয়ের নাম দিয়ে আরো বেশী দুনিয়ার ফাঁদে আটকে ফেলছে মানুষকে। আরো বেশী স্বার্থপর করে তুলছে। সেই ভাই জায়গার অপচয়ের কথা ভাবলেন, কিন্তু সেই জায়গার চিন্তায় হয়তো উনার একটু খুশু খুজুর নামাজ কমে গেল, বা একটু ইসলাম স্টাডি করার সময় কমে গেল, একটু পরকালের কথা ভাবার সময় কমে গেল সেসব ভাবলেন না। আসলে শয়তান ভাবতে দিল না।

আমি যে দেশে থাকি, সেখানে প্রায়ই বিভিন্ন বাংগালীদের সাথে দেখা হয়, আর উনারা আমার হাজব্যান্ড কে ডিসকারেজ করতে থাকেন যে কেন বাংলাদেশে বেড়াতে যাওয়া আমাদের উচিত হবে না! সেদিন ওই ভাই এসেও সেই পরামর্শই দিয়ে গেলেন!

তো কি সেই কারন? মূল কারন যেটা সবাই বলেন – দেশে গেলেই অনেক টাকা খরচ। এর ওর জন্য গিফট কেনো, আসা যাওয়ার ভাড়া, সবার আবদার পূরণ ইত্যাদিতে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়, তাই নাকি দেশে যাওয়াই উচিত না।

আমি নিজে ভিন্নভাবে চিন্তা করি। প্রথমত, আমার উপার্জনের টাকা কি শুধু আমার জন্যই বা শুধু আমার বাচ্চার জন্যই? আমার টাকায় কি আমার মা, বাবা, ভাই, বোন, আত্মীয় এদের হক নেই? অবশ্যই আছে। টাকা শুধু ইনকাম করলাম আর ব্যাংক ভর্তি করে জমিয়ে রাখলাম বা নিজে উপভোগ করলাম – এতেই সব সুখ আছে বলে আমার মনে হয় না। অনেক সময় কাউকে গিফট করার মাঝেও আনন্দ আছে, সুখ আছে।

ছোটবেলায় দেখতাম, আব্বু ঈদে নিজের জন্য কিছু কিনুক না কিনুক, বাড়ির সবার জন্যই ব্যাগ ভর্তি করে কিছু না কিছু নিতেন। এরপর বাড়িতে গিয়ে ঈদের আগেরদিন রাতে সবাইকে একসাথে নিয়ে বসে গিফট বের করে দিতেন। এটাকে বলে আনন্দ। আনন্দ ধরে রেখে সুখ নেই, আনন্দ বিলিয়ে দিতে জানতে হয়, এতেই সুখ।

দ্বিতীয়ত, আমার নিয়্যাতের উপরেই যেকোন কাজই ইবাদাতে পরিনত হতে পারে। তাই কাউকে গিফট দেয়ার ব্যপারটাকে বার্ডেন হিসেবে না নিয়ে বরং রাসূল (সা) এর সুন্নত হিসেবে নেই, তাহলে এর বিনিময়ে অনেক সওয়াবও আছে। ইসলাম একটা দ্বীন; জীবন ব্যাবস্থা। শুধু নামাজ পড়া আর রোজা রাখাই এর কাজ নয়।

তৃতীয়ত, অনেকেই বলেন, মানুষকে খুশি করা যায় না, যত যাই দেয়া হোক। আমিও তাই বলি। হাদিসেও তাই এসেছে যে মানুষকে কখনো খুশি করা যাবে না।

সেদিনের সেই ভাই বলছিলেন, দেশে যেতে হলে নাকি মিনিমাম ৩-৪ টা iphone কিনে নিয়ে যেতে হবে। আমি হাসলাম! হ্যাঁ, মানুষের চাহিদা থাকবেই। বিশেষ করে দেশের বেশীরভাগ মানুষই মনে করে যারা বিদেশে থাকে তাদের কাছে টাকার খনি আছে।

কিন্তু আমার কথা হল, কেউ আমার কাছে iphone আশা করলেই যে আমাকে সেটা দিয়ে দিতে হবে, তা কেন? আমি কাউকে গিফট দেবো, সেটা আমি খুশি হয়ে দেব, আমার সামর্থ্য অনুযায়ী দেব। তাতে যদি সে মুখ ভার করে রাখে আর সেই মুখ ভারের চিন্তায় আমি যদি দেশেই না যেতে পারি বছরের পর বছর ধরে, তাহলে সেটা কেমনে কি?

মানুষ কি বলবে সেই চিন্তা করে ডাঃ আকাশ সুইসাইড করে ফেললো কয়দিন আগেই। মানুষের কথা এত চিন্তা করে লাভ আছে? মানুষের মুখ আছে, বলবেই। এত কিছু ধরে বসে থাকার তো কোন মানে হয় না। আমি দেশে যাবো, আমার মা বাবা, শ্বশুর শাশুড়ি, আত্মীয়স্বজন এদের দেখতে, সাথে নিজের রিফ্রেশমেন্ট এর জন্য। সেখানে কে কি ভাবলো, সেসব ভেবে নিজের শান্তি দূর করার কোন মানে আছে?

যারা লেখাটি পড়ছেন, বেশীরভাগ পাঠকই বাংলাদেশের। তাই অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন এই লেখার মাধ্যমে তাদের কি কিছু জানার আছে? আমি মনে করি আছে।

বাংলাদেশেও এখন খুবই আত্মকেন্দ্রিক একটা সমাজ গড়ে উঠছে। এ যুগের ছেলেপেলেরা উপার্জনের টাকায় বন্ধুবান্ধব নিয়ে চিল করতে, ট্যুরে যেতে বা নিত্যনতুন পোশাক কিনতে যতটা আগ্রহী, নিজের গ্রামে কোন আত্মীয়কে কিছু দিতে প্রায় ততটাই অনাগ্রহী। আবার দেশে থাকা কিছু মানুষ তাদের বিদেশে থাকা আত্মীয়দের প্রতি এতই বেশী উচ্চাকাঙ্খা পোষণ করেন মনে যে অনেক প্রবাসী ভয়েই দেশে যেতে চায় না৷

আসলে সবকথার শেষকথা হল বৃত্তের বাইরে আসা উচিত আমাদের। ভাবতে শেখা উচিত। মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো উচিত। সেলফিশের মত চিন্তা ভাবনা নিজেকেই শান্তিতে থাকতে দেবে না।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ প্রবাসী যারা এই লেখাটি পড়ছেন, তাদের জন্য বলছি। দেশে না যাওয়ার পেছনে আপনার অনেক কারনই থাকতে পারে। আসা যাওয়ার বিমান ভাড়া আসলেই অনেক। অনেকের ছোট বাচ্চা নিয়ে জার্নিতে কষ্ট তাই যেতে চান না।

আরো নানা কারন। কিন্তু আমার এই লেখাটা শুধু সেসব মানুষের চিন্তাভাবনাকে উদ্দেশ্য করে লেখা, যারা সামর্থ্য থাকার পরেও নিজের আত্মীয়দের কে একটু গিফট দিতে হয় বলে বছরের পর বছর দেশে যান না, এমনকি নিজের মা বাবাকে দেখতেও না৷

দেশে গেলে টাকা খরচ

ফারিন আশরাফী

জুলাই ০৯, ২০১৯ইং