উমরাহ ও আমরা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

আল্লাহ্‌র অশেষ কৃপা আর রাহমায় আমরা ফেব্রুয়ারিতে উমরাহ করতে যাই সপরিবারে- অবশ্য আমাদের পরিবার মানে টোনাটুনির ঘর- আমি, আবু ফাতিহা আর আমাদের ফাতিহা। ফাতিহাকে নিয়ে একা সবকিছু কুলোতে পারবো কিনা ভেবে সাথে আমার আম্মুকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি। আর আম্মুও এক কাঠি সরস- সুযোগ হেলায় হারাতে চাননি। আমাদের সাথে উড়াল দেন আল্লাহ্‌র ঘর দেখবেন বলে, আলহামদুলিল্লাহ।

যাওয়ার আগে আমরা খুব করে গ্রুপ তৈরী করে যেতে চাচ্ছিলাম কেননা বাচ্চাটা অনেক ছোট, একাধিক মানুষ হলে বাচ্চা সামলাতে আর তাওয়াফ করতে সুবিধা পাওয়া যাবে এই চিন্তা থেকে। তবে, আল্লাহ ক্বদরে যা লিখে রেখেছিলেন- তাই কাউকে আমাদের সময়ের সাথে মেলাতে পারিনি। অগত্যা, গ্রুপবিহীন আমরা একাই রওনা হই।

ছোট বাচ্চা নিয়ে আরো অনেকেই হাজ্জ্ব উমরাহ করেন। তবে এক এক জনের অভিজ্ঞতা, সুযোগ কিংবা সমস্যা একেক রকম হয়। আমি আজ সেটা নিয়েই লিখবো ইন শা আল্লাহ যদি অন্য কারো উপকার হয় এর দ্বারা।

ফাতিহার তখন ৯ মাস ২৩ দিন। আমার প্রথম এবং প্রধান চিন্তা ছিল ফাতিহার খাবার। ফাতিহা ব্লেন্ড খায়, নয়তো ভীষণ চোকিং হয় ওর। আর ও খিচুরিতে অভ্যস্ত। এগুলোর ব্যবস্থা কী করা যায় কিংবা অল্টারনেট কী হতে পারে- তা অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি। অনেকে বলেছেন রেডিমেড বেবি ফুডগুলো দিতে ট্র্যাভেলিং টাইমে- যেমন কাস্টার্ড, বা পরিজ আর ফ্রুট পিউরি।

আবার দু একজন বলেছিলেন ছোট্ট রাইস কুকার নিয়ে যেতে। আমার তো ব্লেন্ডার নেয়াই লাগবে। তাই আমি রাইস কুকার আর ব্লেন্ডার দুটাই নেই। আল্লাহ্‌র ক্বদর, রাইস কুকার হোটেল এ এলাউ করলো না। ওরা রেখে দিল। তাছাড়া আরেকটা সমস্যা ছিল, মক্কা মদীনার কোন হোটেলেই ওভেন এর সুযোগ ছিল না।

আমরা আল্লাহ্‌র রহমতে টপ হোটেলে থেকেছি, তাই মনে হয় না কোথাও ওভেন দেয়। ব্লেন্ডার এমনি পড়ে ছিল, কাজে লাগেনি। যাওয়ার আগে আমি ঘরে সেরেলাক তৈরি করেছিলাম বাচ্চা খায় কিনা দেখতে। খায় নি। তাই, পুরোটা সফর আমাকে রেডিমেড বেবি ফুডের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ সেটার সুযোগ পেয়েছিলাম।

দেশ থেকে গার্বার (whole wheat/ multi grain) তখন একমাত্র খাবার। আর হোটেল ব্রেকফাস্টের ফ্রুট রুম টেম্পারেচারে এনে মাঝে মধ্যে খাইয়েছিলাম। এভাবে ১০ দিনের সফর পার করেছি আলহামদুলিল্লাহ। সে নিয়ম করে বিনা দ্বিধায় খেলেও ওর ওজন কমে গিয়েছে।

আমরা যেই রাতে মাক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দেই, তার আগের দিন থেকে ফাতিহার বেশ সর্দি হয়। এরপর চোখ দিয়ে কেতুর আসে পরদিন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম কী করবো এই সময়। বাচ্চার চোখ দিয়ে নাক দিয়ে পানি ঝড়ছে, দুধ টেনে খেতে পারছেনা, খাদ্যে অরুচি- এইসব অনিশ্চয়তা নিয়ে প্লেনে উঠি।

ডাক্তার দেখিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু সর্দির কোন উপশম হয়নি। প্লেনে সে যথারীতি ঘুম আর কান্না করেই পার করেছে কেননা পেটে ক্ষুধা, খেতে না পারার যন্ত্রণা, ৮ ঘন্টা এসি কমার্ট্মেন্টে আটকে থাকা- ওর যেন নাভিশ্বাস হচ্ছিল। তার উপর চলল ear block। সব মিলিয়ে যাত্রা যেন আর শেষ হচ্ছিলোই না।

তবে সৌদিয়া (সৌদি এয়ারলাইন্স) এর air hostess রা অত্যন্ত অমায়িক আর সাপোর্টিভ। ওরাও ফাতিহাকে শান্ত করার যারপরনাই চেষ্টা চালায়- কখনো কোলে নিয়ে, কখনো হাসিয়ে খেলিয়ে কিংবা ভুলিয়ে ভালিয়ে, আলহামদুলিল্লাহ।

মাক্কা যেয়ে আমরা বেশ শীত পাই, যা আমাদের অনুমানের বাইরে ছিল। একে বাচ্চার ঠান্ডা, রুমে এসি, বাইরে ঠান্ডা- ফাতিহাকে বাইরে বের করবো কীনা বুঝতে পারছিলাম না। আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে পৌঁছানোর রাতেই আমরা উমরাহ সম্পন্ন করি আলহামদুলিল্লাহ। আবু ফাতিহা বাচ্চাকে কোলে বেল্ট বেঁঁধে প্লেনে এবং তাওয়াফ- সাফা মারওয়া দৌঁড়ানো সবটাই একা করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।

ফাতিহার উন্নতি না দেখে আমরা মাক্কাতেই একটা ফার্মেসিতে যাই ,ওখানের ফার্মাসিস্ট দুটো ওষুধ দেন। আল্লাহর হুকুমে ওষুধ জাদুর মত কাজ করে, ফাতিহা ১.৫-২ দিনের মধ্যে ৯০% সুস্থ। আলহামদুলিল্লাহ। আবহাওয়াও আরামদায়ক হয়ে গিয়েছে ততদিনে। শুধু চিন্তায় ফাতিহার খাবার।

আরেকটা বিষয় ছিল, ফাতিহা আমাকে পেলে আর কারো কাছে যেতে চায়না। আমি আমার আম্মুকে আনলেও ফাতিহা কিছুক্ষণ নানুর সাথে খেলতো, কিন্তু আমাকে দেখলে সে আমার কাছেই থাকবে বলে অস্থির করতো। এজন্য আমি ৪ দিনের মধ্যে ৩ বার তাওয়াফ করি, আর মসজিদুল হারামে এক বেলার বেশি নফল নামাজ আদায় করতে পারিনি। কেননা বাইরে কিছুক্ষণ থাকলে ওর আবার ঠান্ডা লেগে যেত।

আলহামদুলিল্লাহ আমরা ০ মিটার থাকার সুবাদে হোটেলের কামরাও নামাজটাও আল্লাহ একই নেকিতে কবুল করবেন বলে দুয়া করেছি।

মাদিনাতে আলহামদুলিল্লাহ ফাতিহা অপেক্ষাকৃত সুস্থ। এখানে মাক্কার চেয়ে রোদ ছিল বেশি। তবে খুব বেশি নফল ইবাদাত করা হয়নি মাসজিদ আন-নববীতে যেয়ে। কেননা ফাতিহা ঘরের মত বাইরেও আমার সাথেই আঠার মত লেগে থাকতো।

এখন উল্লেখ করবো কিছু পয়েন্ট যা অবশ্যই আমলে নেয়া উচিত ছোট বাচ্চাসহ উমরাহতে গেলে (আমার অভিজ্ঞতানুসারে) ; ছোট বলতে প্রায় ২.৫ বছর বয়সের সমান/কম বুঝাচ্ছিঃ

গ্রুপে যান। গ্রুপে এমন অন্তত একজন থাকা জরুরি যার কাছে আপনার বাচ্চা স্বাচ্ছন্দে থাকে, অন্তত ঘন্টাখানেক। এতে করে মধ্যবর্তী সময়ে আপনি তাওয়াফ করা কিংবা সা’ঈ করার কাজ সেরে নিতে পারেন, কিংবা মসজিদে বসে নফল ইবাদত করতে পারেন।

গ্রুপে অবশ্যই একাধিক পুরুষ রাখবেন যদি একাধিক নারী থাকে। কেননা খাবারের বন্দোবস্ত করা, ফরজ নফল ইবাদাত করা, জিয়ারা করা, সব দায়িত্ব একজন পুরুষের কাঁধে পড়লে খুব সহজেই হাঁপিয়ে উঠবেন তিনি।

বেশি কাপড় চোপড় নেবেন বাচ্চার জন্য। কেননা সফরে কাপড়ে ময়লা ভরে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া যেকোন কিছুই হতে পারে।

বাচ্চার খাওয়া দাওয়া নিয়ে আগেই পরিকল্পনা করে নিন। ভিন্ন দেশে গিয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে- এতে বাচ্চার ওজন কমতেও পারে, সেরকম এক্সেপ্টেন্স মনের মধ্যে তৈরী করে রাখুন।

বাচ্চা বিহীন উমরা/হাজ্জ্ব আর বাচ্চা ছাড়া কখনোই এক হবেনা। তাই মনের মধ্যে ইবাদাতে ঘাটতি পড়ছে এই কষ্টটা যেন হতাশায় রূপ না নেয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আল্লাহ এর উপর ভরসা করে সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন সর্বোচ্চ ইবাদাত করার।

প্লেনে ear block হয় অনেক বাচ্চারই, আবার বড়দেরও হয়। তখন বাচ্চা বেশ কান্নাকাটি করে। এসময় বাচ্চাকে অন্যকিছুতে ব্যস্ত রাখা বা খাওয়াতে থাকা, ইত্যাদি করতে পারেন। ডিটেইলস এর জন্য শেখ গুগলকে জিজ্ঞেস করে নিন।

বাচ্চার জন্য স্ট্রলার নেয়া জরুরি। তবে যত ছোট হয় তত ভালো। শোয়া-বসা দুই সিস্টেমেরটা একটু বেশি বড় হয়ে যায় যদিও আমরা ওটাই নিয়েছিলাম। স্ট্রলার অবশ্য মসজিদে নিয়ে ঢুকা যাবেনা, তাওয়াফ করতেও না। মসজিদের বাইরেও তো অনেক বিশাল স্পেস থাকে, সেখানে আপনি বাচ্চাকে স্ট্রলারে বসিয়ে রেখে সালাত আদায় করলেন। তবে ফরজ নামাজের সময় অনেক ভিড় হয়, তাই আগে যেয়ে জায়গা করে নেয়া লাগবে, আর নয়তো পিছের দিকে বসলে স্ট্রলার নিয়েও সুবিধা আছে।

আর সাথে ক্যারিয়ার বেল্ট জরুরি। কোলে ধরে রাখার চেয়ে ক্যারিয়ার বেল্ট আরামদায়ক। ফাতিহা এভাবেই অধিকাংশ সময় ঘুমিয়েছিল, আমরাও আরামে তাওয়াফ করেছিলাম আলহামদুলিল্লাহ। বাচ্চাকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে ক্যারিয়ার বেল্ট কিনুন কোনটাতে সে আরাম পায় সেটা বুঝতে।

পরিশেষে বলতে চাই, শুরুতেই যেই কাজটি জরুরি, তা হল বিশুদ্ধ নিয়ত আর যারপরনাই দু’আ। আল্লাহর কাছে চান, তিনি সহজ করে দেবেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর ঘরটা দেখা, নবী (স) আর সাহাবাদের সেই একই পথে পা মাড়ানোর যে নস্টালজিক অনুভূতি হবার তৌফিক – তা এমনি এমনি হয়না। এর জন্য বিশেষ অনুগ্রহ লাগে। তাই, আল্লাহর তরফ থেকে নিজেকে ‘মনোনীত’ মনে করলে ইনশাআল্লাহ বাকি ঝামেলাগুলো আহসান হয়ে যাবে।


উমরাহ ও আমরা
– উম্ম সুমাইয়্যা

(২৯/০৪/২০১৯)