কে বোঝা, যায় না বোঝা

মিনা কার্টুনে একটা পর্ব ছিল। মিনার চাচার ট্রাক্টর আছে একটা, ঋণের টাকা দিয়ে কেনা। চাচার ছেলে একদিন মিনাকে দেখায় ইঞ্জিন ঝামেলা করলে কীভাবে কার্বুরেটর ব্যবহার করে ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে হয়।
সেই চাচাত ভাইয়ের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা৷ সবাই চাচ্ছে ছেলে হোক। কারণ ছেলে মানুষ আয় রোজগার করতে পারে৷

যেদিন সন্তান হবে, সেদিন চাচার ট্রাক্টর রেললাইনের উপরে এসে আর স্টার্ট নেয় না। রেললাইনে ট্রাক্টর, আরেকদিক থেকে ট্রেন চলে আসছে। চাচার সাথে তখন মিনা আর মিঠু ছিল। মিনার চট করে কার্বুরেটরের কথা মনে পড়ে৷ মিঠুও ততক্ষণে কা কা কার্বুরেটর রব তুলেছে। এরপর মিনা আর মিঠুর চেষ্টায় ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়।

চাচা খুব খুশি। মেয়ে মানুষ ফেলনা না। মাইয়ারা মেকানিকও হইবার পারে। ট্রাক্টরে করে বাড়ি ফিরে ওরা। জানতে পারে চাচার নাতনী হয়েছে। তাতে পাড়া প্রতিবেশী বিরক্ত হলেও মিনার চাচা ততক্ষণে মেয়ে মানুষের কদর বুঝে গেছে।

মেয়েরা এই হতে পারে, সেই হতে পারে। তাই মেয়ে সন্তান হলেও সমস্যা নাই। এই সেই হয়ে সম্ভাব্য ক্ষয়-ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া যাবে।

এই কার্টুন মোটাদাগে আমাদের মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। সমাজ বলল মেয়েরা সমাজের বোঝা। এদেরকে খাওয়াতে হয়, পরাতে হয়, আমৃত্যু অর্থকড়ির যোগান দিতে হয়।

তাই সমাজের মানুষ কী করল? সমাজের মানুষ কিন্তু সমাজকে বলল না, কয়েকটা মানুষকে আমৃত্যু অর্থকড়ির যোগান দিতে হলেই তারা বোঝা হয়ে যায় না, ফেলনা হয়ে যায় না। তাদের হেলাফেলা করার লাইসেন্স চলে আসে না।

সমাজের মানুষ অদ্ভুত এক সমাধান বের করল। তারা প্রথমেই স্বীকার করে নিল মেয়েরা সমাজের বোঝা। এরপর তারা খুঁজতে লাগল কী করলে মেয়েরা আর ‘বোঝা’ থাকবে না।

মেয়েদের ডিগ্রী না থাকলে সমাজে সংগ্রাম করতে হয়। মেয়েদের ইনকাম না থাকলে সংগ্রাম করতে হয়।
কেউ এসে বলল না, সমাজকে বলে দিব, ডিগ্রী আর ইনকাম দিয়ে তোমাকে যেন না মাপে।

সবাই বলল, “দেখেছ, ডিগ্রী না থাকলে কী হয়?”
“দেখেছ, ইনকাম না থাকলে কী হয়?”
ওদিকে যে সমাজ মানুষ হিসেবেই গণ্য করে না মেয়েদের, সেই সমাজের স্বীকৃতি পেতে মেয়েদের কত চেষ্টা! যেকোনো মূল্যে, শত কষ্টের পরও বুঝিয়ে দেয়া চাই আমরা ‘বোঝা’ থাকতে চাই না।

মেয়েদের কি তবে পড়াশোনা, চাকরি নিষেধ? কেন তা হবে? কেবল মানসিকতাটা সমস্যা।
আমি কিছু করলাম, সমাজ দেখল।
আর সমাজকে দেখিয়ে দেবার জন্য আমি কিছু করলাম।

দুইটার মধ্যে কোনটা দাসত্ব, বুঝতে কি কষ্ট হয়?
নিজেকে যদি সমাজের দাস মনে না করি, তবে নিজেকে বোঝা হিসেবে মেনে নিলাম কেন?
যে সমাজ প্রতি পদে পদে আমাকে দাবিয়ে রাখতে চায় বলছি, সে সমাজে নিজের কদর বাড়াতে চাইলাম কেন?

শুরুতেই কেন বললাম না আমি বোঝা নই? শুরুতেই কেন বললাম না ডিগ্রী আর ইনকাম দিয়ে সামাজিক অবস্থান মাপা বন্ধ করো?

কেন বললাম না আমার ডিগ্রী ইনকাম নিজেকে কারও কাছে প্রমাণের জন্য না?
আমরা যে সমাজকে দুয়ো দেই, সেই সমাজের মানদন্ডকেই আদর্শ মানি। এরপর সমাজের চোখে যা সফলতা, তা ছুঁতে পারলে বাকবাকুম করে নিজের সংগ্রামের গল্প বলি। কেমন করে এলাম আজকের এই পথে। আর ছুঁতে না পারলে হীনম্মন্যতায় মাটির সাথে মিশে যাই।

খুব প্রিয় একটা হাদীস বলি:
“তোমাদের মধ্যে থাকা দুর্বলদের কারণে কেবল তোমাদেরকে সাহায্য করা হয় এবং রিযিক প্রদান করা হয়।” [বুখারী]

আপনার আমার সফলতার সব অহংকার এই হাদীসে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে। বৃদ্ধ বাবা, কম বুদ্ধি শুদ্ধির ছেলেটা, এবং ‘সবদিক সামলে সিরিয়ালের নায়িকা’ হতে না পারা মেয়েটা দুর্বল। কিন্তু বোঝা না। এই দুর্বলদের কারণেই আমাদের এত রিযিক।

আমাদের বরং ভাবা উচিত চোখের সামনে যখন আর কোনো ‘বোঝা’রা থাকবে না, সবাই যখন সফল, আত্মনির্ভর আর উপার্জনকারী হয়ে যাবে, রিযিকে বরকত কাদের জন্য আসবে?

কে বোঝা, যায় না বোঝা

আফিফা আবেদীন সাওদা

সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৯ইং