তাজকিয়া

দীল আফজা সাবিনা

আমার কাছে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন যে ইসলাম অনুযায়ী জীবন যাপনের ক্ষেত্রে কোন ব্যাপারটা সবচেয়ে কঠিন, আমি নির্দ্বিধায় বলব, সেটা হচ্ছে অন্তরের পরিশুদ্ধকরণ বা তাজকিয়া আল-নাফস। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, এই নামাজ বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য শরীর ও পোশাককে পরিচ্ছন্ন রাখা, বছরে এক মাস রোজা রাখা, বহু কষ্টার্জিত সম্পদের আড়াই পারসেন্ট বাধ্যতামূলকভাবে যাকাত হিসেবে দরিদ্রকে দিয়ে দেয়া, প্রচন্ড গরমের মধ্যেও আপাদমস্তক আবৃত করে পর্দা করা ইত্যাদি – এগুলো কঠিন কাজ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু, যে কোনো আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য এর নিয়্যতকে পরিশুদ্ধ রাখা অনেক, অনেক বেশি কঠিন!

অন্তরটাকে শির্ক, রিয়া (লোক দেখানো ইবাদত), অহংকার, রাগ-ক্ষোভ-জেদ, হিংসা ঈর্ষা, ঘৃণা, লোভ, হতাশা, পরশ্রীকাতরতা, পরছিদ্রঅন্বেষণ, সন্দেহ আর কুসংস্কার থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা; অন্তরকে আল্লাহর প্রতি আশা-ভরসা ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে তোলা; সৃষ্টিকর্তার প্রতি ও তাঁর অন্য বান্দাদের প্রতি প্রকৃতভাবে কৃতজ্ঞতা অনুভব করার চেষ্টা করা — আমার মতে, যে কোনো শারীরিক ইবাদত সম্পাদনের চাইতে বহু বহুগুণে কঠিন!

অন্তরটাকে শির্কমুক্ত রাখা কঠিন! আমার কথা শুনে অনেকেই হয়ত ইতোমধ্যে ভ্রু কুঁচকে ফেলেছেন। ভাবছেন, এটা আবার ক্যামন কথা! ভাবছেন, আমরা তো আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো উপাসকের ইবাদত করি না! জ্বী, আমরা তা হয়ত করি না। কিন্তু, তা না করলেই যে আমাদের অন্তর একেবারে শির্কমুক্ত, এরকম ভাবার কারণ হচ্ছে একটাই। আর তা হচ্ছে ‘তৌহিদ’ অর্থাৎ আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানের অভাব।

আমরা হয়ত পৌত্তলিকদের মত মূর্তির সামনে সিজদা দিই না, বা নাসারাদের মত ঈসা আলাইহিস সালামকে ঈশ্বর ভেবে তাঁর উপাসনা করি না। কিন্তু, আমাদের মধ্যে অনেকেই কি মাজারে যেয়ে কবরে শুয়ে থাকা মানুষদেরকে (তাঁরা বুজুর্গ ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ না থাকলেও) সিজদা করেন না? যে সন্তান শুধুমাত্র আল্লাহ দিতে পারেন, তা কি তাঁদের কাছে কেউ চান না? কেউ গণকের কাছে যান না ভাগ্য গণনা করতে, বা তার দেয়া বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন পাথরের আংটি এনে আঙ্গুলে পরেন সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে ফেলার অভিপ্রায়ে। কিংবা কেউ জীবিত কোনো পীর-ফকিরের কাছ থেকে তাবিজ এনে পরম যত্নে সেগুলো শরীরে লটকে রাখেন সন্তান পাওয়া, রোগমুক্তি, ব্যবসায় উন্নতি বা দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তি ফিরে পাওয়ার আশায়। আর, বাচ্চাকে কুনজর থেকে বাঁচানোর জন্য কপালে ইয়া বড় একটা কালো টিপ দেয়া, এটা তো আমাদের কাছে কিছুই না! আপাদমস্তক কালো কাপড়ে আবৃত মহিলাটির কোলেও যে বাচ্চাটিকে দেখবেন, তার কপালেও একটা কালো টিপ দেয়া থাকে। অথচ, আমরা যদি বিশ্বাস করি যে ওই কালো টিপের কোনো ক্ষমতা আছে বাচ্চাকে কুনজর থেকে রক্ষা করার, সেটা হবে সুস্পষ্ট শির্ক।

এবার আসি রিয়া নিয়ে। আমাদের অনেকেই প্রতিদিন কত পাতা কুরআন তিলাওয়াত করি, সপ্তাহে কয়টি রোজা রাখি, কত রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ি, দরিদ্রকে কত দান করি, আল্লাহর প্রতি আমরা কতটা কৃতজ্ঞ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে খুব গল্প করতে পছন্দ করি। কেউ কেউ তো এসব নিয়ে ফেসবুকেও স্ট্যাটাস দেন। কিন্তু, এ ধরণের কাজ করার আগে অন্তরটা হাতড়ানো দরকার – শুধুমাত্র, শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে যদি তিল পরিমাণ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যও আমাদের থেকে থাকে, তবে এই আমলগুলোর জন্য আল্লাহর কাছে কোনো প্রতিদান তো পাওয়া যাবেই না, উল্টো এগুলো জঘন্য ঘৃণিত কাজে পরিণত হবে, যার নাম হচ্ছে ‘রিয়া’ বা ‘ছোট শির্ক’।

অন্যের গীবত করায়ও আমাদের জুড়ি মেলা ভার! কিন্তু, কারণটা কি? কারণ হচ্ছে, আমাদের অহংকার! আমরা নিজেদের অবস্থান — হোক সেটা সামাজিক, আর্থিক, দৈহিক বা অন্য কিছু, এমনকি ধার্মিকতা নিয়ে এতটাই আত্মতৃপ্ত যে অনায়াসেই আমরা নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে উঁচুস্তরের মনে করি এবং যে বা যারা আমাদের দৃষ্টিতে নিচুস্তরের, তাদেরকে নিয়ে নির্দ্বিধায় গীবত করা শুরু করি! কখনো কখনো এই গীবত করার পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করে আমাদের হিংসা, লোভ কিংবা পরশ্রীকাতরতা। প্রায়শই আমাদের ঈর্ষাকাতর বা পরশ্রীকাতর অন্তর আদা-জল খেয়ে পরছিদ্রঅন্বেষণে লিপ্ত হয়, যার অবধারিত পরিণাম হচ্ছে গীবত।

এভাবে যদি বিশ্লেষণ করতে থাকি, দেখা যাবে যে, যেসব কাজগুলোই আল্লাহ তায়ালার কাছে অপছন্দনীয়, সেগুলোর প্রত্যেকটার পেছনেই কোনো না কোনো ভাবে অন্তরের পরিশুদ্ধকরণের অভাব দায়ী! ঈমাম ইবনুল কাইয়্যিম একটা সুন্দর কথা পড়লাম আজ – “কবরে একজনের অবস্হা কেমন হবে, তা নির্ভর করে তার অন্তরের অবস্থার উপর।”

খুবই ভয়াবহ কথা! আসুন, আজ থেকে সবাই মিলে আমাদের শরীর এবং পোশাকের মত মনটাকেও পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টায় রত হই। আর, আল্লাহর কাছে খুব বেশি করে দুয়া করি, তিনি যেন আমাদের জন্য এই কাজ সহজ করে দেন। আমীন।

………………….