শান্তিময় সে রাত..

🔲 শবে ক্বদর বা লাইলাতুল ক্বদর কি..?
—————————-
শবে ক্বদর একটি ফারসী শব্দ। আরবীতে এটি লাইলাতুল ক্বদর। ‘লাইলাতুল’ অর্থ হলো রাত্রি বা রজনী এবং ‘ক্বদর’ শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা, মহাসম্মান। এর মানে লাইলাতুল ক্বদর অর্থ হলো অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা পবিত্র রজনী। এ ছাড়া ক্বদরের এর অন্য অর্থ হলো —ভাগ্য, পরিমাণ ও তাকদীর নির্ধারণ করা।

🔲 পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ

“রমাদান মাস, এতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের হেদায়াতের জন্য এবং হিদায়াতের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে।” [সূরা আল-বাকারা:১৮৫]

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা অন্যত্র বলেন,

اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰہُ فِیۡ لَیۡلَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ
“নিশ্চয় আমি এটা নাযিল করেছি এক মুবারক রাতে। ” [সূরা আদ-দুখান:৩]

আল-কুরআন লওহে মাহফুযে সংরক্ষিত ছিল। সেখান থেকে আল্লাহর নির্দেশে সম্মানিত ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ) রমাদানের কোন এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট কুরআনের কয়েকটি আয়াত নিয়ে আসেন। এরপর অবশিষ্ট কুরআন পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ধাপে ধাপে পূর্ণ তেইশ বছরে নাযিল করা হয়। রমাদানের যে রাতে রাসূল (সাঃ) এর উপর মানব জাতির পথনির্দেশক হিসেবে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছিল সে রাত-ই শবে ক্বদর বা লাইলাতুল ক্বদর নামে পরিচিত।

🔲 লাইলাতুল ক্বদরের রাতে কি হয়..?
—————————————–
পবিত্র কুরআনের সূরা আদ-দুখানের ৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,

فِیۡہَا یُفۡرَقُ کُلُّ اَمۡرٍ حَکِیۡمٍ

“সে রাতে প্রত্যেক চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থিরকৃত হয়।”

এই রাত্ৰিতে তাকদীর সংক্রান্ত বিষয়াদি নিম্পন্ন হওয়ার অর্থ এ বছর যেসব বিষয় প্রয়োগ করা হবে, সেগুলো লওহে মাহফুয থেকে নকল করে ফেরেশতাগণের কাছে সোপর্দ করা। নতুবা আসল বিধি-লিপি আদিকালেই লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। [ইমাম নববী: শারহু সহীহ মুসলিম, ৮/৫৭]

এ রাতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিযিক, বৃষ্টি ইত্যাদির পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাগণকে লিখে দেয়া হয়। [সা‘দী]

অর্থ্যাৎ এ রাতে আগামী এক বছরের ভাগ্যলিপি
বা পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় ফেরেশতাগণের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কাদের জন্ম হবে, কাদের বিয়ে হবে, কাদের মৃত্যু হবে, কারা ধনী হবে, কারা দরিদ্র হবে ইত্যাদি সমস্ত ভালো খারাপ বিষয়ের বিধিলিপি পরিচালনার জন্য ফেরেশতাদের কাছে দেওয়া হয়।

🔲 লাইলাতুল ক্বদরের গুরুত্ব:
——————-
মহিমান্বিত লাইলাতুল ক্বদরের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে বেশি ; অর্থাৎ তিরাশি বছর চার মাসের চেয়ে ও বেশি। সুবহান আল্লাহ্…! এর মর্যাদা ও গুরুত্ব বোঝানোর জন্য আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা একটি সূরা ও নাযিল করেছেন; আর তা হলো সূরা ‘আল-ক্বাদর’। সূরা আল-ক্বাদরে আল্লাহ্ বলেন,

اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰہُ فِیۡ لَیۡلَۃِ الۡقَدۡرِ ☑
নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি ‘লাইলাতুল ক্বদরে’ ।

وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ ☑
আর আপনাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল-ক্বদর’ কী ?

لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ ۬ۙ خَیۡرٌ مِّنۡ اَلۡفِ شَہۡرٍ ☑
লাইলাতুল-ক্বদর’ হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ

تَنَزَّلُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَ الرُّوۡحُ فِیۡہَا بِاِذۡنِ رَبِّہِمۡ ۚ مِنۡ کُلِّ اَمۡرٍ☑ ۙ

সে রাতে ফিরিশতাগণ ও রূহ্ নাযিল হয় তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে।

سَلٰمٌ ۟ۛ ہِیَ حَتّٰی مَطۡلَعِ الۡفَجۡرِ ☑
শান্তিময় সে রাত, ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত।
[সূরা আল-ক্বাদর:১-৫]

🔲 কবে লাইলাতুল ক্বদর..?
——————-
আমরা এটা জানি যে রমাদানের শেষ দশকের যেকোন এক রাত লাইলাতুল ক্বদরের রাত। কিন্তু কোন রাত সেটা আমরা কেউই জানি না। আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) কে একদা প্রশ্ন করা হলো লাইলাতুল ক্বদর কবে? তখন রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

« تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ

“রমাদানের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতে তোমরা লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান কর।” [বুখারি:১৯১৩]

এছাড়া রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছিলেন,
“আমাকে লাইলাতুল ক্বদর দেখানো হয়েছিল; কিন্ত পরে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে তা অনুসন্ধান কর।” [বুখারী, মুসলিম]

সে হিসাবে আমরা বেশিরভাগই ধরে নিই যে, ২১, ২৩, ২৫, ২৭ এবং ২৯ রমাদানের যে কোন এক রাতে লাইলাতুল ক্বদর।

🔲 লাইলাতুল ক্বদরের রাতের কিছু বৈশিষ্ট্য:
————————-
ওবায়দা বিন সামেত এই রাতের পরিচয়ের কথা এভাবে বলেছেন, ভাগ্য নির্ধারণীর এ রাতে আকাশ থেকে কোন উল্কাপিন্ড নিক্ষিপ্ত হয় না। এই দিনের ভোরের আলো প্রখর থাকে না। সকালে পূর্ণিমা চাঁদের মতো স্নিগ্ধ আলো হবে। [শুআবুল ঈমান, হাদীস-৩৬৯৩]

এছাড়াও অন্যত্র এ রাতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে —
☑ রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না।
☑ রাতটি নাতিশীতোষ্ণ হবে অর্থাৎ সে রাতে গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না।
☑ সে রাতে মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে।
☑ সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত বেশি তৃপ্তি বোধ করবে।
☑ সে রাতে বৃষ্টি হতে পারে।
☑ কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ্ স্বপ্নে সে রাত সম্পর্কে হয়তো জানিয়ে ও দিতে পারেন।
☑ সকালে হালকা আলোকরশ্মি সহ সূর্যোদয় হবে ; যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো।
[ বুখারী:২০২১, মুসলিম:৭৬২]

“লাইলাতুল-ক্বদরের রাত্রিতে পৃথিবীতে ফেরেশতারা এত বেশী অবতরণ করে যে, তাদের সংখ্যা পাথর কুচির চেয়েও বেশী হয়।”
[মুসনাদে আহমাদ: ২/৫:১৯, মুসনাদে তায়ালাসী: ২৫৪৫]


শান্তিময় সে রাত..
ইসমত কণক

(২৬/০৫/১৯)