কান নিয়েছে চিলে

আপা, ও আপা!

রহিমা বুয়া বার তিনেক ডাকার পর হুঁশ ফিরলো ডঃ ফিরোজার। মগ্ন হয়ে একটা রিসার্চ আর্টিকেল পড়ছিলেন। খুবই ইন্টারেস্টিং আর্টিকেলটা। ঢাকা বিশ্যবিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ডঃ ফিরোজা। দেশ বিদেশের বিখ্যাত জার্নালে তার পেপার নিয়মিত পাবলিশ হয়। তবে তিনি বিশ্বাস করেন এর অনেকটুকু অবদান রহিমা বুয়ার। সে আছে বলেই বিশাল একটা সময় রিসার্চের পিছনে দিতে পারেন তিনি। নিজের মত করে গুছিয়ে কাজ করে সে, খুব কমই তার কাজের খবরদারী করতে হয়। আজকের দিনে ঢাকা শহরে তার মত কাজের বুয়া থাকা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার শামিল। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল ফিরোজা যখন পড়াশোনার কাজ করেন তখন সেটা বুঝতে পারে রহিমা বুয়া, পারতপক্ষে ডিস্টার্ব করে না তাকে। তাই হঠাৎ তার এই ডাকে বেশ অবাকই হলেন তিনি।

কী ব্যাপার বুয়া? 
একটা কথা জিগানোর জন্য আইছি। 
বলো!
আমাফো বস্তিতে সবাই কইতেসে, আসছে জুম্মাবারে বাসার বেসিন দিয়া হগগলে এক লগে ব্লিচিং পাউডার ঢাইলা দিলে বলে সব ডেঙ্গু মশা যাইবো গা! যারা নানান বাড়িত কাম করে, তারা করবো এই কাম বলাবলি করতাসিলো। হুইনা আমার কেমুন য্যান লাগলো। টুনির বাপ গত জুম্মায় মসজিদ থন হুইন্যা আইসে যে ইমাম সাব কইসে চট কইরা সব কথা য্যান আমরা বিশ্বাস না করি। আল্লাহর মানা আসে। এই ছেলেধরা আইসা বাচ্চা লইয়া যাইবো এইটাও নাকি ভুয়া কথা। তাই ভাবলাম আপনারে জিগাই! এই কথাটা কি ঠিক আপা?

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো রহিমা বুয়া আর কথাগুলো শুনে থ হয়ে রইলেন ফিরোজা। ব্লিচিং পাউডার দিলে এডিস মশা মরবে কিভাবে এটার লার্ভা তো থাকে পরিষ্কার স্বচ্ছ পানিতে! এভাবে বেসিন দিয়ে সবাই ব্লিচিং পাউডার ঢেলে দিলেতো সেটা ড্রেন দিয়ে ওয়াসার পানির লাইনের সাথে মিশে যেতে পারে, নদী নালা গুলোর মাঝে গিয়ে পড়লে মাছ, জলজ নানা প্রাণীর মারাত্মক সর্বনাশ হতে পারে। এটাতো চরম আত্মঘাতী একটা কাজ হতে যাচ্ছে। কে রটাচ্ছে এসব গুজব! তাদের উদ্দেশ্যই বা কী!

রহিমা বুয়াকে এত বিস্তারিত না বলে খালি বললেন ভুলেও এই কাজ করবে না। একদম ভুল কাজ এটা। ডেঙ্গু মশা জন্মায় পরিষ্কার পানিতে, হারপিক দিয়ে এটা মরে না, বরং এভাবে আমাদের খাওয়ার পানিতে হারপিক মিশে যেতে পারে।

তার আঁতকে ওঠা চেহারা আর এই ব্যাখ্যা শুনেই কনভিন্সড রহিমা বুয়া। জানালো এখুনি গিয়ে বস্তির অন্যান্য মানুষদের এটা জানিয়ে দিবে সে।

রহিমা বুয়া চলে যাওয়ার পরও চরম অস্বস্তিটা যাচ্ছিলো না ডঃ ফিরোজার। হাতে মোবাইল তুলে নিলেন। দুদিন পর একটা কনফারেন্সে ফুল পেপার সাবমিশনের ডেডলাইন আছে বিধায় অনলাইন জগত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন। বড্ড সময় নষ্ট হয় একবার ফেসবুক বা হোয়াটস অ্যাপে ঢুকলে। তবে এটার সমস্যা হচ্ছে একদমই কিছু জানাও যায় না তাছাড়া। তাই ভাবলেন একটু জানা দরকার কী ঘটছে বাইরের দুনিয়ায়। ফিরোজা বেশ কিছু হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের মেম্বার , কিন্তু অনেক মেসেজ আসে দেখে নোটিফিকেশন অফ করে রেখেছেন। সেগুলো চেক করতে গিয়ে বিস্ময়ে থ হয়ে গেলেন-সবগুলো গ্রুপেই দেখি এই আহ্বান ওয়ালা মেসেজ এসেছে! আসছে জুম্মাবারে সবাই একসাথে………

কিছুক্ষণ অবাক হয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইলেন ফিরোজা। আসলেই কী এই মেসেজগুলো তার ডাক্তার, স্কুলের শিক্ষিকা ফ্রেণ্ডদের দ্বারা ফরওয়ার্ডেড হয়েছে? এদেরকে কি আদৌ শিক্ষিত বলা যায়? 
একটা বিশা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফিরোজা। সেই পুরান কথাটাই আবার যেন নতুন করে উপলব্ধি করলেন- আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান মানুষকে এমন একটা ‘সেন্স’ দেয় যেটা দুনিয়ার হাজারটা ডিগ্রী দিতে পারে না। ইমাম সাহেব বলেছেন যে রহিমা বুয়ার যে আক্কেল আছে সেটা তার তথাকথিত শিক্ষিত ফ্রেণ্ডদের নাই। মনে পড়লো সূরা হুজুরাতের আয়াতটা-

মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও। (৪৯:৬)

কী গভীর একটা কথা। আমরা একবার যদি মেনে চলতাম তাহলে এভাবে কি যাচাই না করে স্রেফ শেয়ার অপশনে ক্লিক করে দিতাম? ডঃ ফিরোজার আরো মনে পড়লো-
অতএব জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তোমাদের জানা না থাকে (১৬:৪৩)
যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে। (১৭:৩৬)

এ বিষয়ে হাদীসও আছে-
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: কোন লোকের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে (সত্যতা যাচাই না করে) তা-ই বলে বেড়ায়। (মুসলিমঃ৫)

আসলে অনলাইন দুনিয়াটাই বোধহয় এমন। খুব সহজে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় এই ব্যাপারটার একটা উন্মাদনা আছে মনে হয়। তাই চিন্তা ভাবনা না করেই ক্লিক করতে থাকি আমরা। কিন্তু যার দ্বীনের বুঝ আছে সেতো বুঝবে যে প্রতিটা ক্লিকের জন্যই সে দায়িত্বশীল। এসব কাজে সময় ব্যয় করি বলেই অনেক সুন্নাতী আমল করি না যা হয়তো আসলেই আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। সহীহ হাদীস থেকে আমরা একটা দুআ জানতে পারি যেটা সকাল বিকাল তিনবার যদি আমরা নিয়ম করে পড়ি তাহলে ডেংগু মশা সহ যাবতীয় ক্ষতিকর প্রাণী থেকে মুক্ত থাকতে পারবো ইনশাল্লাহ। হাদীসটা হচ্ছে

রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন “যে ব্যক্তি সকালে তিনবার ও সন্ধ্যায় তিন বার এই দুআ পড়বে, কোনো কিছুই ঐ ব্যক্তির ক্ষতি করতে পারবেনা”।
بِسْمِ اللهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ العَلِيمُ

আরবী উচ্চারণঃ বিসমিল্লা-হিল্লাযী লা ইয়াদুররু মা আ’সমিহী শাই’উন ফিল আরদি, ওয়ালা ফিস সামা-য়ী, ওয়াহুয়াস সামীউ’ল আ’লীম। (৩ বার)।
বাংলা অর্থঃ আমি সেই আল্লাহর নামে শুরু করছি, যার নামে শুরু করলে আসমান ও যমীনের কোনো কিছুই কোনো ক্ষতি করতে পারেনা। প্রকৃতপক্ষে তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী। (৩ বার)।
আবু দাউদ, তিরমিযী ৩৩৮৮, ইবনে মাজাহ ৩৮৬৯, মুসনাদে আহমাদ ৪৪৮, ৫২৯, হিসনুল মুসলিমঃ পৃষ্ঠা ১৩৮, শেখ আলবানীর মতে হাদীসটি হাসান।

ডঃ ফিরোজা এটা সবসময় আমল করার চেষ্টা করেন, ছেলেমেয়েদের শিখিয়েছেন, সাথে নিচের কাজটাও করেন নিয়মিত। বাসায় ঢুকে, ভার্সিটি যেয়ে নিচের দুআটা পড়েন-

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ

রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন স্থানে অবতরণ করে বলে, ‘আউযুবি কালিমা-তিল্লা-হিত তা-ম্মা-তি মিন শার্‌রি মা খালাক্ব’ (অর্থাৎ, আমি আল্লাহ্‌র পরিপূর্ণ বাক্য দ্বারা তাঁর সৃষ্টির অনিষ্ট হতে আশ্রয় কামনা করছি)। কোন কিছুই তাঁর ক্ষতি করতে পারবে না, এ স্থান ত্যাগ না করা পর্যন্ত।” (মুসলিম ২৭০৮)

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিদ্ধান্ত নিলেন ডঃ ফিরোজা-আরো বেশী সময় দাওয়াতী কাজে ব্যয় করতে হবে। অবশ্যই যে রিসার্চগুলো তিনি করেন, সেগুলোকে ইবাদাত মনে করেন বলেই করেন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মাঝে তার একটা অন্যরকম গ্রহণযোগ্যতা আছে তিনি টের পান। সেটা কাজে লাগিয়ে আরো বেশী অফলাইনের দুনিয়ায় ব্যস্ত হতে হবে ইনশাল্লাহ। তার আগে নিজে থেকেই ফোন করলেন সুমনকে, তার ভাগিনা, একটা শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক, নিজেই ফোন করে বললেন যে তার রেফারেন্স দিয়ে যেন ছাপিয়ে দেয় যে এটা একটা ভুয়া নিউজ।

আমরা সবাই যদি নিজের দায়িত্বগুলো এভাবে পালন করি তাহলে এই ‘কান নিয়েছে চিলে’ টাইপ গুজবগুলো আমাদের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে না ইনশাল্লাহ।

কান নিয়েছে চিলে
হামিদা মুবাশ্বেরা

অগাস্ট ০১, ২০১৯ইং