ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া

উম্মে লিলি


টিমটিমে আলো জ্বলছে বিশাল হলরুমে। বড় টেবিলে লোক ভরপুর। কলিগ শফিক ভাইয়ের সাথে জমিয়ে গল্প করছে রুমি। খাবার সার্ভ করছে ছোকড়া পিয়নটা। টুংটাং চামচের শব্দে হলরুম ছন্দময়। কাঁচা মাংসের তীব্র বোঁটকা গন্ধ নাকে লাগছে। টেবিলের পাশেই সাদা কাপড়ে মুড়ানো দুটো লাশ। পিয়ন বারবার লাশ দুটো থেকে মাংস কেঁটে কেঁটে প্লেটে রাখছে। রুমি আর শফিক মুখে পুড়ছে আর গল্প চালিয়ে যাচ্ছে। 

হঠাৎ কী মনে পড়ে লাশের দিকে তাকায় রুমি। এটা কী তার আদরের ছোট ভাই অমির লাশ নয়! সে কী করছে! গা গুলাতে থাকে রুমির। সাথে প্রচন্ড কষ্ট আর আতংক। কবে মারা গেল অমি? চোখ বেঁয়ে পানি গড়ায়। হেচকি তুলে কাঁদতে থাকে রুমি। কাঁদতে কাঁদতে উঠে বসতেই ঘুম ভেংগে যায়। এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিল। হেচকি আর গোঙানো থামতে সময় লাগে। কাঁপা হাতে পানি ঢেলে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নেয় ও। মোবাইলের নীল আলোটা জানান দিচ্ছে ম্যাসেজ এলার্টের কথা। শফিক ভাইয়ের সাথে জাফরকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল ঘুমের আগে।

অফিসে যত শ্রম বা মেধাই দেক না কেন ওরা কয়েকজন, বসের মন কেড়ে নেয় সবসময় জাফর। একটা মানুষ কীভাবে এতো তেল দিতে পারে বসকে সেটাই মাথায় আসে না ওদের। জাফরকে নিয়ে আরো কিছু হয়তো লিখে থাকবেন শফিক ভাই। কিন্তু ওসব পড়ার মানসিকতা নেই এখন রুমির। দ্রুত ম্যাসেঞ্জারে অমিকে কল দেয়। অমিকে অনলাইন দেখাচ্ছে। কিন্তু কল রিসিভ করছে না। অস্থির লাগে রুমির। অমির ম্যাসেজের এলার্ট আসতেই জলদি দেখে নেয় , “ল্যাবে,আরজেন্ট কিছু?” ।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রুমি। নর্থ আমেরিকায় পিএইচডি করতে গেছে তার আদরের ছোট ভাইটা। আল্লাহ ওকে সবসময় ভালো রাখুক এই দুআই করে সে। এসব আজেবাজে স্বপ্ন আসলে সারাদিনের উদ্ভট চিন্তার ফল। আবার শুয়ে পড়ে সে। এপাশ ওপাশ করে ঘুম আসে না। রাবেয়ার ছবিগুলো বের করে দেখে। আগে রাতে ঘুম না আসলে রাবেয়া কে ফোন দিতো সে, আদর করে রাবেয়াকে ডাকতো রাবু-বাবু। রাবেয়ার সাথে সামান্যতম যোগাযোগ নেই রুমির, আফসোস-কষ্ট কিছুই নেই এখন আর।

তবু অভ্যাসবশত ছবিগুলো দেখে সে। মোবাইলের টকটাইমগুলো শেষ হতো রাবেয়ার সাথে কথা বলে, রাত কখন পার হয়ে যেতো খেয়ালই থাকতো না। এখন রাত পার হয়ে মুভি দেখে, কলিগদের সাথে চ্যাট করে। সময় সেতো ঠিকই পার হয়, মাধ্যম শুধু পরিবর্তিত হয়। ছবিগুলো দেখতে দেখতে আবার ঘুমে তলিয়ে যায় রুমি। স্বপ্নের রাজ্যে ঢুকে পড়ে আবারো…প্রচন্ড আগুনের উত্তাপ। পা পুড়ে যাচ্ছে রুমির। গায়ে একটা সুতা কাপড় নেই। অতল গহবরে পড়ে আছে সে আর আরো অনেক নগ্ন নারী পুরুষ, কেউ কারো দিকে ফিরে পর্যন্ত চাইছে না। আগুনের লেলিহান শিখা উপরে উঠে আসছে। গায়ে লাগতেই চিল-চিৎকার সবার… বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ঘুমন্ত রুমির কপালে। কিছু কিছু রাত কেবল যেন দুঃস্বপ্ন নিয়ে হানা দেয়।

এলার্ম বা আযানের আগেই জেগে যায় রাবেয়া। পায়ে ঠান্ডা লাগছিল দুধ সাগরে পা ভিজিয়ে। ঘুম কেটে যাওয়ায় বুঝলো দুধ সাগর না, পা ভিজেছে খোলা জানালা দিয়ে আসা পানির ছিটায়। বৃষ্টি পড়ছে, জানালাটা জলদি লাগালো। ঘড়ি দেখে বুঝলো ফযরের আযানের এখনো বাকি। ওযু করে এসে আস্তে ধীরে জায়নামাজে বসতেই আযান কানে আসে। সলাহ পড়তে গিয়েও বারবার স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায়। ইশ কী সুন্দর ছিল স্বপ্নটা। সিজদাহতে দুআ করে আল্লাহ যেন এমন সুন্দর জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ করে দেন।

নামায শেষে নিজের জন্য এক কাপ কফি করে নেয়। এই সময়টা রাজ্যের ঘুম চোখে ভর করে। কিছুটা জড়বস্তুর মতো ওঠানামা করে সলাহ পড়ে নেয় প্রতিদিন। আজ খুব ঝরঝরে লাগছে, হয়তো স্বপ্নের আবেশে। কফি নিয়ে ভেজা জানালার পাশে চুপচাপ বসে স্বপ্নের কথা ভাবে… ঘনসবুজ এক বাগানের মধ্যে খালি পা ফেলে হাটছে রাবেয়া। সামনে বিশাল এক গাছ,গাছের ছায়ায় বসার ইচ্ছা। পাশেই ঝরণা দিয়ে পানি ছিটকে বের হচ্ছে। নিজের গায়েও অদ্ভুত সুন্দর রেশমি পোশাক, এতো আরামদায়ক কোনো জামা কোনোদিন ও পরেনি। গাছ পর্যন্ত আসতেই আর বসার ইচ্ছা হলো না, গাছটার পরই একটা বাড়ি। সোনালি-রূপালি ঝলমলে রঙের। বাড়িটা টানছে চুম্বকের মতো। কিন্তু গাছ শেষ হয় কই। এই গাছ পাড়ি দিতেই মনে হয় অনেক বছর পেরিয়ে যাবে। সোনা রূপার ইট দিয়ে গাঁথা বাড়িটা, চোখ ফেরানো দায়।

বাড়ির ভেতর পা রাখে রাবেয়া অদ্ভুত ভালো লাগা মন ছুয়ে যায়। কোনো মন খারাপ- কষ্টের কথা মনে পড়ে না। ভিতরে ঢুকতেই আপ্যায়ন শুরু হয় আদা দেয়া অসাধারণ স্বাদের শরবত দিয়ে। আরো কত জানা-অজানা ফল নিয়ে আসছে দশ- বারো বছরের সুন্দরমুখের ছেলেরা। মুখে দিতেই বুঝা যাচ্ছে ফরমালিন দেয়া নেই ফলগুলোতে, পৃথিবীর গাছ-পাকা কোনো ফলের সাথেও স্বাদের তুলনা হয় না। সোনা-রূপার পাত্রে সব পরিবেশন করা হচ্ছে। জানালা দিয়ে আরো অনেক বাড়ি দেখে রাবেয়া। আকাশের তারার মতো বাড়িগুলো যেন শূন্যে ঝুলে আছে। স্বচ্ছ দেয়ালের কিছু বাড়ি বাইরে থেকেও দেখা যাচ্ছে। খুব ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করছে সবকিছু। রাবেয়া বেড়িয়ে পড়ে। বিশাল গোল একটা মুক্তো ঝুলে আছে, যেন বিশাল হলরুম একটা। রাবেয়া এক-মুক্তোর সেই বাড়িতে ঢুকে পড়ে। মা-সহ আরো অনেক চেনা মুখকে ভেতরে দেখে, কিন্তু কেউ যেন কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। মাকে জোরে ডাক দেয় রাবেয়া, মা শোনে না।

মা একদম তরুণী হয়ে গেছেন, কিন্তু মা তো মা-ই। রাবেয়া চিনতে একদম ভুল করেনি। মুক্তো-ঘর থেকে বের হয়ে এসে সাগরপাড়ে গিয়েছিল রাবেয়া। সাগরের পানি না, দুধের স্রোত। আজল দিয়ে মিষ্টি দুধ খেয়ে নেয় রাবেয়া। অথচ দুধের গন্ধে ওর কতো বমি আসে। সবুজ আলখেল্লা মতো জামার নিচের দিকটা ভিজে যাচ্ছে দুধে.. ঘুমটা তখনই ভেংগেছিল। কখনো সমুদ্রসৈকত যায়নি সে। রুমির সাথে কতো প্ল্যানই না করতো সে। টাইট-জিন্স আর ফিটিং টিশার্ট পরে সাগরপাড়ে দৌড়াবে, ছবি তুলবে কত পোজে; সবাই যেমনটা করে আরকী। আল্লাহর ইচ্ছায় মৌমিতা আপু ওর জীবনে আসলো আর একটু একটু করে বদলে যেতে লাগলো ওর সব চিন্তা।

সামান্য একটা গ্রুপ স্টাডি থেকে আপুর সাথে পরিচয় হয়েছিল। এক-আধটু পর্দায় রুমি কিছু বলেনি, বাংলাদেশি মেয়েদের ফ্যাশনই এখন হিজাব। যেদিন থেকে রুমির সুদি ব্যাংকে চাকরি নিয়ে কথা বলা শুরু করলো রাবেয়া, সেদিনই মতাদর্শ নিয়ে ঝগড়ার সূত্রপাত। আর কালো আবায়া নেয়ার পরও কয়েকদিন হারাম সম্পর্কটা ঝুলে ছিল কোনোভাবে। তারপর একদিন রাবেয়াই সাহস করে সব চুকিয়ে দেয়। রুমি ঝুলাঝুলি করেনি, বিদ্রুপ করেছে বরং।

রাবেয়া বারবার অনুরোধ করেছিল ওর সব ছবি যেন রুমি মুছে ফেলে, অনেক তওবা করেছে অতীতের ভুলের জন্যে। কক্সবাজার রুমির সাথে যাওয়া না হোক, স্বপ্নে তার থেকেও সুন্দর জায়গা ঘুরে এসেছে। পৃথিবীর বাইরের কোথাও, জান্নাতি দৃশ্য যেন। জান্নাতের বর্ণণা জানেনা রাবেয়া, আজ খুব মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। আপুর উপহার দেয়া কুরআনের বাংলা কপি নিয়ে বসে। পড়বে পড়বে বলে পড়াই হচ্ছিলো না। আজকের স্বপ্নটা সব জড়তা কাটিয়ে দিলো।


হঠাৎ সম্পূর্ণ ঢাকা একজন সামনে চলে আসায় ঘাবড়ে যায় রুমি। ভুত-ভূত লাগছিলো। এমনিতেই রাতের বেলার দুঃস্বপ্নগুলো তাড়া করে ফিরছে। সন্ধ্যার পর এমন আপাদমস্তক ঢাকা মহিলা দেখে তাই আরো ভয় লাগলো। শুনেছে রাবেয়া নাকি এখন এমন পর্দা করে। ভাগ্যিস দেখা হয়নি, মুখের উপর হেসে ফেলতো। সুদের চাকরি বলে মেয়েটা যে পরিমাণ ঘ্যান ঘ্যান করতো তা সহ্য করার মতো ছিল না। ইসলামে বিশ্বাসী রুমিও, তাই বলে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলবে না নাকি! ব্যাংকের সুদ তো লাভ দেয়া, এটা বোকা মেয়েটাকে বুঝাতে পারেনি। তাও ভাল, বিয়ের পরে রাবেয়া দ্বীনের পাবন্দ হয়ে যায়নি। হলে তো ডিভোর্স ছাড়া উপায় ছিল না, এমন যাত্রার বিবেকের সাথে কী আর ঘর করা যায় নাকি। শেষ ম্যাসেজটা মনে পড়ে আজও হাসি পায় রুমির – “হয়তো তুমি পাপের পথে যেতে যেতে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াবে আর আমি পূণ্য থেকে পিছলে পাপে।

তবু জেনে বুঝে হারামকে আজ ছুটি দিলাম।” রুমিও উত্তর দিয়েছিল, “কেনো গো! তুমি কেন পিছলে যাবে। তোমার জান্নাতের জমিটা বেদখল করলো কে?” আর কোনোদিন কোনো উত্তর আসেনি ওই নাম্বার থেকে, রাবেয়া আর রুমির কল রিসিভ করেনি। বিরক্তির শেষ সীমায় পৌছে গেছিল রুমি। তাই কোনো কষ্ট লাগেনি। রাবেয়ার কথা ভাবতে ভাবতে বাসার গেইটে এসে থামে রুমি। ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে জলদি।

আজ দুঃস্বপ্ন না দেখলেই হয়। আগে চাইলেও স্বপ্ন দেখতো না, আর আজকাল না চাইতেও দুঃস্বপ্ন। চোখ বুজে আসে সারাদিনের ক্লান্তিতে। স্বপ্নরাজ্যের প্রবেশ দ্বারও খুলে যায়… লাল নদী, মনে হচ্ছে যেন রক্তের নদী। পানিতে হাবুডুবু খায় রুমি। সাতরে ঐ পারে যেতেই হবে। একজন বসে আছে তার জন্যে, খুব কষ্টে ঐ পারে পৌছায় রুমি। তার মুখে পাথর ঠেসে দেয়া হয়। দম আটকে আসলেও কিছু করার নেই। বারবার সাতরে মুখে পাথর নিয়ে যায় রুমি। দৃশ্যপ্যট পাল্টায়, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যেয়েও পারে না। প্রচন্ড গরম। আগুনের উত্তাপে কষ্ট হচ্ছে খুব। কাছেই একজন গম্ভীর মুখের পাহারাদার, পৃথিবীর সেরা কমেডিয়ানও বুঝি হাসাতে পারবে না তাকে । “পানি! পানি” কাতরায় রুমি। কেউ একজন পানি দেয়। ফুটন্ত গরম পানি খেয়ে নাড়ি-ভুড়ি সব যেন গলে যাচ্ছে। “এটা স্বপ্ন! এটা স্বপ্ন! অনন্তকাল এমন হতে পারেনা, মাত্র কিছুক্ষণ আর।” প্রচন্ড যন্ত্রণায় সে বিড়বিড় করে ঘুমের ঘোরে।

#রৌদ্রময়ী_গল্প