হিংসা ও আনুগত্য

বিন্তে খাজা

ঘটনা ক)
রায়হানার মেয়েটা পাবলিক মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেছে একবারেই। ওর মামাতো বোন শেলীর শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার মেয়েটা এত চেষ্টার পরও পাবলিক কেন, প্রাইভেটেও চান্স পেল না। 

কিন্তু শেলী মেয়েকে মেডিকেলে পড়াতে চায় সবার কাছে গর্ব করে বলতে পারার জন্য। আর রায়হানার মেয়েকে ভালো কোন পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াতেই হবে, না হলে হয়ত যেনতেন একটা কোথাও মেয়েকে ভর্তি হতে হবে। রায়হানার সৎ পথে ব্যবসা করা স্বামীর ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছে আজকাল। ওর মেয়েও সেটা বুঝে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে সেভাবেই কঠোর পরিশ্রম করেছে। কিন্তু সচ্ছলভাবে চলা শেলী ভেতরের ব্যপার ভেবে দেখল না, বোনের মেয়ের ভালো সংবাদে কথায় কথায় হিংসাটা প্রকাশ পেয়েই গেল।

ঘটনা খ)
প্রায় বছর তিনেক ধরে অনেক ছেলে দেখার পর নিপার বিয়ে ঠিক হোল। ওদের চাহিদা বেশি কিছু ছিল না, মোটামুটি আয়ের ভালো একটা ছেলে, ব্যস। এটুকু মিলতেই ছেলেরা যখন পছন্দ করল আর দেরী করল না ওর বাসা থেকে। পাশের বাড়ির আন্টি খবরটা শুনে কোনভাবেই নিজের হতাশা ঢাকতে পারলেন না। উনার মেয়ের জন্যও হন্যে হয়ে ছেলে খুঁজছে। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ভালো স্যলারি না হলে উনি দিতে চান না, মেয়েও রাজি হয়না। নিপার বিয়ের খবরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করলেন। সবদিক ওদের পছন্দমতো হয়েছে শুনে এক দুইটা বাঁকা মন্তব্য করতেও ছাড়লেন না। অল্পে তুষ্ট নিপার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

ঘটনা গ)

ফেসবুকে শায়লার বাবু হওয়ার খবরটা দেখে দীর্ঘশ্বাসটা আটকে রাখতে পারল না শারমিন। মনে হোল, আশপাশে সবাই মা হয়ে যাচ্ছে, আল্লাহ্‌ খালি ওকেই দিলেন না! এতদিন মনে হতো শায়লাও ওর মতোই একই কষ্টে আছে, পোস্টটা দেখার পর থেকে মনে হচ্ছে শায়লার কষ্টের দিনগুলো শেষ হয়ে গেল। কেন যেন খুশি হতে পারছে না শারমিন কলেজ জীবনের বান্ধবির এই খুশির খবরে। শারমিন জানল না কত মানসিক কষ্ট সহ্য করে সন্তানকে এই পৃথিবীতে এনেছে শায়লা। বাচ্চাটা পেটে আসার পর থেকেই শ্বশুরবাড়ির সবার মুখ ভার, সময়ে অসময়ে তীর্যক মন্তব্যও করে ফেলত তারা। শায়লার স্বামীর স্বল্প আয়ে খরচের বোঝা বাড়াতে কেউই আগ্রহী ছিল না এই সময়ে। সন্তান তার নিজের রিযিক নিয়েই দুনিয়ায় আসবে, আল্লাহর ওপর ভরসা করে পুরো সময়টা পার করেছে শায়লা। কিন্তু এসব কথা তো আর ফেসবুকের পোস্টে লেখা থাকে না।

……….

প্রতিটা মানুষ পৃথিবীতে কোন না কোন পরীক্ষার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে। যার স্বামী ভালো তার হয়ত সন্তান নেই, যার সন্তান আছে তার হয়ত সুস্থতা নেই। কেউ হয়ত বাবার বাড়ির সহযোগিতা পায় না কিন্তু শ্বশুরবাড়ির মানুষজন আন্তরিক। কারো হয়ত শ্বশুরবাড়ির মানুষ আঘাত দিয়ে কথা বলে, কিন্তু বাবার বাড়ি থেকে আদরের কমতি নেই। যার দুটোই ভালো সে হয়ত নিজের চট করে রেগে যাওয়ার স্বভাব নিয়ে মনে মনে লড়ে যাচ্ছে। যাকে বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে সবকিছুই ভালো তার হয়ত আল্লাহর সাথে সম্পর্কটা খুব নড়বড়ে এবং সে সেটা বুঝতেই পারছে না। আর শেষেরটাই সবচেয়ে মারাত্মক পরীক্ষা। কিন্তু প্রতিটা মানুষই দুনিয়ার জীবনে পরীক্ষা দিচ্ছে। আল্লাহ্‌ বলেছেন,

“পৃথিবীর উপর যা কিছু আছে আমি সেগুলিকে ওর শোভা করেছি তাদেরকে (মানুষকে) এই পরীক্ষা করবার জন্যে যে, তাদের মধ্যে কর্মে কে শ্রেষ্ঠ।” [কুরআন ১৮:৭]

অর্থ্যাত যা কিছু আমাদের কাছে ভালো বলে মনে হয় – ভালো বর, ভালো ঘর, ফুটফুটে সন্তান, আন্তরিক আত্মীয় স্বজন – সেই সবকিছুই আবার আমাদের জন্য পরীক্ষা। আমরা কী এসব পেয়ে আল্লাহকে ভুলে যাই নাকি এসব ব্যবহার করে আল্লাহর আরও কাছে যেতে চেষ্টা করি? তাই, যে বস্তুটা বাইরে থেকে খুব ভালো কিছু মনে হচ্ছে সেটা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যবহার না করলে তা নিয়ামত হওয়ার পরিবর্তে আমাদের জন্য কষ্টের কারণ হতে পারে। যখন অন্য কেউ আমার দৃষ্টিতে ভালো কিছু পেয়ে যাচ্ছে তখন ভাবা দরকার আমি সেটা পেলে কী করতাম? যদি উত্তরটা হয় এমন যা দিয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা যাবে তাহলে আমাদের উচিত মনে মনে সেই ব্যক্তির জন্য দু’আ করা যেন আল্লাহ্‌ তার ওই নিয়ামতে বারাকাহ দেন। তাহলে কী হবে জানেন? একজন মুসলিম যখন তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দু’আ করে তখন ফেরেশতারাও তার জন্য একই দু’আ করে। সুবহানআল্লাহ!

অপরদিকে, হিংসা আপনাকে মানসিকভাবে কিছুটা হলেও খারাপ রাখবে। আপনি মনের ভেতর অশান্তি অনুভব করবেন। সেই সাথে নিজের আখিরাতের ক্ষতি তো আছেই। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “হিংসা মানুষের নেক আমলকে এমনভাবে ধ্বংস করে, যেভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে দেয়।“ (আবু দাউদ) অন্যদিকে, অপরের জন্য দু’আ করে দিলে ফেরেশতারাও আমাদের জন্য একই দু’আ করবেন। লাভ কোথায় বেশি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
আমরা অনেকেই সালাত আদায় করি, রামাদানে সিয়াম পালন করি, পর্দা করি কিন্তু অন্যের ভালো কিছু দেখলে, বিশেষ করে এমন কিছু যা আমার নেই, আমরা মনের ভেতর কষ্ট অনুভব করি। আল্লাহর প্রতি আমাদের আনুগত্য কি তবে শুধুই বাহ্যিক আমলের মাঝে সীমাবদ্ধ? ভাগ্যে বিশ্বাস করা আমাদের ঈমানের অংশ। আল্লাহ্‌ বলেছেন,

“নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা, এবং ধন ও প্রাণ এবং ফল শস্যের অভাবের কোন একটি দ্বারা পরীক্ষা করব এবং ওইসব ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ প্রদান করুন।” [কুরআন ২:১৫৫]

আমরা আল্লাহর ফয়সালায় অনুগত হই তিনি এটাই চান এবং সেটা হতে পারলে অনেকসময় আল্লাহ্‌ পরীক্ষাকে সহজ করে দেন বা একদমই সরিয়ে ফেলেন। যখন কোন পরীক্ষার মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন তখন দু’আ করার পাশাপাশি আর কী করবেন? নিজের জানা-অজানা, ছোট-বড় গুনাহের জন্য ইস্তিগফার করুন। আল্লাহ্‌ কুরআনে উল্লেখ করেছেন নূহ (আলাহিস সালাম) উনার জাতিকে বলেছিলেন,
“তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা প্রার্থনা কর, তিনি তো অতিশয় ক্ষমাশীল, তিনি তোমাদের জন্য আকাশ হতে প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন, তিনি তোমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে এবং তোমাদের জন্যে বাগানসমূহ তৈরি করবেন এবং প্রবাহিত করবেন নদী-নালা।” [কুরআন ৭১:১০-১২]

ক্ষমা প্রার্থনা করুন, আল্লাহ্‌ সন্তুষ্ট হলে নিয়ামতের দ্বার উন্মুক্ত করে দিবেন। যা অন্যের আছে নিজের নেই সেটার দিকে তাকানোর আগে আসুন তাকাই নিজের কী কী আছে, এরপর সেসবের জন্য শুকরিয়া আদায় করুন। আল্লাহ্‌ আরও বলেছেন,
“তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদেরকে অবশ্যই অধিক দিব।” [কুরআন ১৪:৭]

কৃতজ্ঞ অন্তর অর্জন করতে সচেষ্ট হই আসুন, যে জিনিসের অভাব আছে তাও একসময় আল্লাহ্‌ পূরণ করে দিবেন যেভাবে উনি ভালো মনে করেন। কখনো মনে করবেন না আপনার জীবনের ওপর আপনার নিয়ন্ত্রণ নেই। আপনার ভাগ্য আপনিই গড়তে পারেন। আল্লাহর ব্যপারে সুধারণা পোষণ করুন। হাদিস কুদসিতে আছে, আল্লাহ্‌ বলেছেন, আমি আমার বান্দার কাছে তেমন যেমন সে আমাকে ভাবে। আপনি আল্লাহর থেকে নিজের জন্য ভালোটাই আশা করুন, তাঁকে আপনি তেমনই পাবেন।

হিংসার পথ দুনিয়ায় মানুষকে মানসিকভাবে অস্থির করে তোলে আর আখিরাতে আমল বিনষ্ট করে। অন্যের জন্য দু’আ করে, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে, নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে, আল্লাহর সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করে নিজের সৌভাগ্য গড়ে নেয়ার ক্ষমতা আছে আমাদের হাতেই। আনুগত্যের পথেই আছে শান্তি আর সফলতা।

#রৌদ্রময়ী_ফ্রাইডেরিমাইন্ডা