অপরাজিতা

১।
আচ্ছা ধরো আমার নাম অপরাজিতা, যার বর্তমান পরিচয় শুধু একটা লাশ। তাল পুকুরের চারপাশের ভীড়টা ক্রমশ বাড়ছে, আমি ভেসে ভেসে বেশ দেখতে পাচ্ছি। আমার অনেক লজ্জা লাগছে। কারন কাপড়চোপড় এলোমেলো হয়ে আছে, ঠিক করতে পারছিনা। অথচ আমাকে আগে কেউ এভাবে বেপর্দা অবস্থায় দেখেনি। ভীষন অস্বস্তি হচ্ছে। 

এরই মাঝে দেখলাম আলতাফ চেয়ারম্যান লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে এসেছেন। তাদের দিয়ে ঠ্যাংগিয়েও লোকজন সরাতে পারছেন না। চেয়ারম্যানের নির্দেশে চারজন গাট্টা গোট্টা লোক পুকুরে নৌকা দিয়ে আমার লাশটাকে টেনে ডাঙ্গার কাছে নিয়ে আসলো। 

সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত। কোন কোন স্থানে হাড়ও বের হয়ে গেছে। নিজেকে চিনতেই পারছিনা। বড় চাদর পেঁচিয়ে আমাকে উঠোনের এক কোনায় জারুল গাছের ছায়ায় বিছানো চাটাইয়ের উপরে রেখে দিয়ে বাড়ির প্রাচীর লাগোয়া গেইট বন্ধ করে দিল। জনমানবশূন্য উঠোনে লাল শাড়ি পরে খুবলে খাওয়া টাটকা লাশ হয়ে পড়ে আছি। অদূরে কিছু পাইক পেয়াদা কারো নির্দেশের অপেক্ষায় দন্ডায়মান।

বাড়ির ভেতর থেকে একজন বয়স্ক মহিলা নাকে কাপড় চেপে কয়েক মিনিটের জন্য আমার কাছ থেকে ঘুরে গেলেন, চেহারার কাঠিন্য ভাব তখনও বিদ্যমান। ওনার চেহারার নমুনা দেখে আমার ভীষন হাসি পেল হা হা হা, তার স্বভাবটা বুঝি আর বদলালোনা না।

এক হাতে জ্বলন্ত আগর বাতি আরেক হাতে গোলাপজলের বোতল নিয়ে কেউ একজন কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে এল। এসেই আমার শরীরে গোলাপজল ছিটিয়ে দিতে লাগল। ওহ আমি তাকে চিনতে পেরেছি তাকে আমি চাচী বলে ডাকি। গোলাপ জলটা অসহ্য লাগছে। চিত্কার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল যে প্লিজ গায়ে দিওনা, ক্ষতগুলো জ্বলে যাচ্ছে। চাচী আমার দিকে তাকিয়ে কান্নার বেগ আরো বাড়িয়ে দিলেন, “তুই কেন এভাবে আমাকে না বলে চলে গেলি রে মা? তোর কিসের এত কষ্ট, অন্তত আমার সাথেই একটু শেয়ার করতিস!”

চাচীর কান্না দেখে এখন আমারো কান্না পাচ্ছে। কিন্তু আমার পাথর চোখে এখন আর জল নেই, পাথর হয়ে গেছে।

একটু পরে সা সা করে বেশ কয়েকটা গাড়ি বাড়ির সামনে এসে ভিড়ল। গাড়ি থেকে দু’জন মহিলা, দুটো বাচ্চা আর দু’জন পুরুষ লোক নামল। মহিলা দুটো আমার উপরে বিষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে ঘরের ভিতরে চলে গেল। বাচ্চা দুটো কান্না করছিল ওরা নাকি আমাকে দেখতে চায়। জীবিত থাকতে ওদের সাথে আমার ভীষন খাতির ছিল। আমরা ছিলাম একে অপরের অন্তঃপ্রাণ। 

কেউ একজন বারান্দায় এলো সাদা পাঞ্জাবী পরা, চোখে সানগ্লাস। দুঃখী দুঃখী চেহারা নিয়ে অস্থির ভাবে পায়চারি করে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। ওকে আমি বেশ চিনতে পারছি। আরে চিনবই না বা কেন! সে-ই তো আমার স্বামী। আহারে বেচারা বৌ হারিয়ে অপ্রকৃতস্থের মত হয়ে আছে। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কিছু খেয়েছে কিনা কে জানে? আমরা মেয়েরাও যে কি না! মরে গিয়েও শান্তি নাই, এখন ওকে হাতে তুলে খাইয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।

রোদটা এখন মাথার উপরে, চিরবিরিয়ে গরম লাগছে। বেলা গড়ানোর সাথে পাল্লা দিয়ে উঠোনেও মানুষের জটলা বাড়ছে। আমি এবার একটু নস্টালজিক হয়ে পড়েছি। 

আমার বিয়ের দিনও এভাবে সামিয়ানা টাঙ্গানো লাল-সাদা কাপড়ের নিচে অনেক মানুষ এসেছিল। সবাই কত হাসি খুশি, কতশত গল্পে মুখর এক আনন্দ ঘন পরিবেশের প্রতিচ্ছবি। বৌ সাজে আমি লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে বসে আছি। আজও কিন্তু লাল শাড়িতেই মুড়ে আছি, তবে লাশ হয়ে। কী অদ্ভুত তাইনা!

আমার চোখ ঘুরে ফিরে কেবল দুজন মানুষকেই খুঁজে চলছে। তারা এখনও আসছে না কেন? পথে কোন সমস্যা হল নাতো! মনটা অস্থির লাগছে – কতদিন দু’চোখ ভরে তাদের দেখি না। অন্তত আজকে তো একটু আসলে পারে।

যা ভেবেছিলাম তাই হল, তারা ঝড়ের বেগে বাড়িতে ঢুকলেন। তারপর আমার মুখখানি আলতো করে তুলে ধরে কেঁদেই চলছেন। এখন আমার বুকে বড্ড অভিমান জমছে, আগে যখন এতো এতোবার বলেছিলাম একটু আসো তোমাদের দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। অনেক না বলা কথা বুকে জমতে জমতে বুক ব্যথা করছে। তখন তো শুনলেনা।

আর এখন!

আমি অসহায় লাচার, মুখ থাকা সত্ত্বেও জবান বন্ধ। কিছু বলার ক্ষমতা তো নিশুতি রাতে মৃত্যু এসে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।

আমার স্বামী ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। আমার পাশে যে দু’জন বসে কাঁদছেন তাদের সাথে দেখা করতে। ও হ্যা ঐ দুজনের সাথে তো আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেইনি।

তারা হলেন আমার মা-বাবা।

আমার স্বামী তাদেরকে ধরে ভীষন কান্না করতে লাগলেন। আমাকে ছাড়া যে তিনি একা হয়ে গেলেন, এ শোক তিনি নিতে পারছেন না। আহারেহ! শুনে আমারো কান্না পাচ্ছে। বেঁচে থাকতে একদিনও যদি এমন একটা কথা সে বলত, তাহলে খুশিতে আমি পাগল হয়ে যেতাম! আমি আরো ভেবেছিলাম সে বুঝি আমাকে কখনোই ভালোবাসেনা। যাকগে সে সব কথা।

সবাইকে সরিয়ে দিয়ে একদল মহিলা আমাকে গোসল করিয়ে কাফনের সাদা কাপড় পরিয়ে দিল। এবার আমি প্রস্তুত আমার আকাংখিত বাড়িতে যাবার জন্য। কত কত বছর গড়িয়ে গেল সেখানে যাইনি। আমার যেন আর তর সইছেনা।

সূর্য পাটে নেমে গেল। রাত্রির অন্ধকার জেঁকে বসতে না বসতেই আকাশে থালার মত একটা চাঁদ উঠল। চারদিকে আবছা ছায়ায় সবুজ গাছগুলোকে কালচে ভূতুরে লাগছে।

২।
অবশেষে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বাবা মায়ের সাথে গাড়িতে চাপলাম। গাড়ির ভেতরটা ভীষন রকমের ঠান্ডা। শরীর জমে যাচ্ছিল, অথচ কেউ একটা কম্বলও দিলোনা। আমার বরটার উপরে এখন ভীষন রাগ লাগছে।

ও হ্যা, আরেকটা কথা বলতে তো ভুলেই গেছি! সন্ধ্যায় পুলিশ এসেছিল আমাকে নিয়ে যেতে। আমার শ্বশুরমশাই দেননি, তিনি অত্যন্ত কৌশলি মানুষ। অযাচিত ঝামেলা এড়ানোর জন্য একগাদা টাকা দিয়ে এটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছেন। আমার তখন পেট গুলিয়ে হাসি আসছিলো।

আমি এখন ঠান্ডা হীম করা একটা গাড়িতে। ছুটে চলছি তো চলছি। এ চলার কোন বিরাম নেই। গাড়ির ঠাসা দেয়ালের কারনে চাঁদের আলোটা আমার গায়ে পড়ছেনা বলে মন খারাপ লাগছে। জোছনার রূপটা কে আবারো খুব করে দেখতে ইচ্ছে করছে। সেই সাথে আমার বরের চেহারাটাও, কারন সে-ই গতকাল রাতে আমাকে চাঁদ দেখাবে বলে পুকুর পাড়ে নিয়ে গিয়েছিল। 

আমরা পুকুর ঘাটে বসে জোছনা-স্নান করলাম। আমি তার ভালোবাসার চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে ফেলেছি। নতুন করে তাকে আবারো বিশ্বাস করেছি। ভেবেছিলাম হয়ত নিজের ভুল বুঝতে পেরে পরকীয়া থেকে দূরে সরে এসেছে।

ও আমায় গান শোনালো, জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেল। আমি লজ্জায় চোখটা কেবল বন্ধ করছি মাত্র, ঠিক তখনই একটা ধাক্কা আমাকে ছিটকে পুকুরে নিয়ে ফেলল। সাঁতার জানিনা বলে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম, বরকে চিৎকার করে ডাকছিলাম। কিন্তু সে একটি বারও আমার দিকে ফিরে তাকাল না। আমি যন্ত্রনা ভোগ করতে করতে একসময় মরে গেলাম।

জানিনা বাবা-মা আমার মৃত্যুর জন্য কোনটা বিশ্বাস করেছে – হত্যা নাকি আত্মহত্যা। আসলে বিশ্বাস করলেই কি আর না করলেই কি! চেয়ারম্যান সাহেব, মানে আমার শ্বশুরের বিপক্ষে কিই বা করার ক্ষমতা আছে তাদের।

দুনিয়ার মানুষের কাছ থেকে ইনসাফ না পেলেও শেষ বিচারের দিনে আমার আল্লাহ অবশ্যই ইনসাফ করবেন ইনশাআল্লাহ। 

কি বল তোমরা?

[হলি সুরভি]

(২৭ অক্টোবর ২০১৭)