অস্ফুট

কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে একটা হালকা টুং টাং শব্দ। ভীষণ মিষ্টি। বাজছে তো বাজছেই। কখনো আস্তে, কখনো জোড়ে।

আয়েশা হন্য হয়ে খুঁজছে সেই শব্দের উৎস। শুধু সেই টুং টাং না, তার হন্য হওয়ার কারণ- ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসা একটা ছোট্ট শিশুর খিলখিল হাসির শব্দ।

এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ছুটে যাচ্ছে, কিন্তু সেই শিশুর দেখা পাচ্ছে না। এক পর্যায়ে পাগলপ্রায় আয়েশার দৃষ্টি ঘোলা হয়ে যায়, গাল বেয়ে ঝরতে থাকে অশ্রু- টপ টপ। পা দুটো তবু চলতে থাকে, মনের ভেতর আশার প্রদীপটা বুঝি এখনও নেভেনি!

হঠাৎ পেছন থেকে খট করে দরজা খুলে যাওয়ার শব্দ পায় আয়েশা। ঠিক সাথে সাথেই তার মনে হলো হাসির শব্দটা যেন আগের চেয়ে জোড়ে শোনা যাচ্ছে। আয়েশা তৎক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়ায়। ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে দরজাটা আপনা আপনি খুলে যাচ্ছে, কিন্তু খুব ধীরে। রুদ্ধশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করছে আয়েশা। করছে তো করছেই।

তার এ অপেক্ষা যেন অনন্তকাল ধরে…

“আয়েশা আপা, আপনার চা টা-“

স্বপ্নটা ভেঙে যায় নাসিমার ডাকে। আয়েশা টেবিলে গোঁজা মাথাটা বহু কষ্টে সোজা করে উপরে তোলে, তার আগে সাবধানে চোখের পানি মুছে নেয়। ও হ্যাঁ, মাথা ব্যাথা কাটাতেই কড়া এক কাপ চা চেয়েছিল- মনে পড়ে তার। কোন মতে মুখে হাসি ফুটিয়ে, চায়ের কাপটা নিজের হাতে নিয়ে, নাসিমাকে ধন্যবাদ জানায় আয়েশা। নাসিমা চলে গেলে চায়ের কাপে চুমুক দেয় সে। আহ! চা টা এত চমৎকার হয়েছে যে নাসিমার জন্য মন থেকে দুআ চলে আসে! মিষ্টি অল্প না, বেশি ও না। কড়ার মাত্রাটাও একদম ঠিক ঠাক। দু চুমুক খেতেই মাথা ব্যাথা গায়েব হয়ে গেল!

চা খাওয়া শেষ হতেই টিফিনের ঘন্টা দিল- ঢং ঢং ঢং। তার একটু পরই শোনা গেল বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড়। আয়েশার মনে পরে গেল সেই স্বপ্নের কথা। বাচ্চা নিয়ে স্বপ্ন সে প্রায়ই দেখে। বিয়ের পাঁচ বছর পরও সন্তানের মুখ দেখতে পারেনি সে- কি স্বপ্নে, কি বাস্তবে।

“সবই আল্লাহর পরীক্ষা”- মনটাকে এই বলেই বুঝ দেয় আয়েশা। স্বপ্নের চিন্তা বাদ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, হেঁটে যায় জানালার কাছে। টিচার্স রুমের জানালা দিয়ে বাচ্চাদের প্লে গ্রাউন্ডটা দেখা যায়, মনটা খুশি হয়ে যায় দেখলেই। এমনই একটা প্লে গ্রাউন্ড নিজ বাসার জানালা দিয়ে দেখতো আর গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলতো বলে তার হাজবেন্ড তাকে এ স্কুলটাতে টিচার হিসেবে ঢুকতে বলেছিল। কি অদ্ভুত! একই রকম দৃশ্য, অথচ দু রকম অনুভূতি। পার্থক্য- কেবল কাজের চাপ।

টেবিলের উপর স্তূপ হয়ে আছে বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক এর খাতা। সে কথা মনে হতেই আয়েশা ফিরে যেতে নিয়েছিল নিজের টেবিলে। কিন্তু তখনই সে থমকে যায় জানালার বাইরে একজনের দিকে চোখ পড়ায়। একটা ছোট্ট ছেলে গালে হাত দিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে। একদম একা। ক্লাস ওয়ানের আনাস না? নাকি আসাদ? দুই যমজ ভাইয়ের মধ্যে যে একজন, সেইটা নিশ্চিত।

“কি ব্যাপার? মন খারাপ?” -আয়েশার কথাতে চমকে তাকায় আনাস, কাছ থেকে দেখে চেনা যাচ্ছে এবার। কি বলবে ভেবে পায় না সে, চুপ করে থাকে তাই। “টিফিন খেয়েছ?” -এবারে ডানে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকায় আনাস। “চল তাহলে, এক সাথে খাই।”

টিচার্স রুমে অনেক মানুষ এখন, তাই আনাসকে নিয়ে একটা ফাঁকা ক্লাসে গিয়ে বসলো আয়েশা। চা খেয়ে আর তার ক্ষুধা নেই। তবু একটা বিস্কিটের প্যাকেট খুলে একটা খেলো, আনাসকেও সাধলো। কিন্তু আনাস না সেই বিস্কিট খেলো, না খেলো নিজের টিফিন। আয়েশা একটু ধারণা করার চেষ্টা করলো মন খারাপের কারণ- “কোনো সাবজেক্টে কম মার্কস পেয়েছ?”
-“হুম, সব সাবজেক্টেই।”

ক্লাস টেস্টের খাতা দেখানো হচ্ছে গত দুইদিন ধরে, তাই এমনটা হতে পারে ধরে নিয়েছিল আয়েশা। কিন্তু আনাস ভালো স্টুডেন্ট। সব সাবজেক্টে কম পাওয়ার কথা না। তাহলে কি নিজের ভাই এর সাথে তুলনা করে বলছে?

-“আসাদ কেমন করেছে?”
-‎”ও তো সব গুলাতেই হায়েস্ট, একটা বাদে। আম্মু ওকেই বেশি আদর করবে এখন।”

বেচারা অনাসের চোখ জোড়া ছলছল করছে। আয়েশা কি বলবে ভেবে পেলো না। হঠাৎ মনে হতেই বললো- “কিন্তু ড্রয়িং… সেটাতে তো তুমিই হায়েস্ট পেয়েছ!” ওদের ড্রয়িং খাতা আয়েশা নিজে চেক করেছে বলে সে জানে। আনাসের আঁকা অদ্ভুত সুন্দর ফলের ঝুড়ি সে নিজে টিচার্স রুমের সবাইকে ডেকে ডেকে দেখিয়েছে। ছেলেটার আঁকার হাত খুবই ভালো।

-“শুধু তো ড্রয়িং।”
-‎”শোনো আনাস, আল্লাহ আমাদের একেক জনকে এক রকম বানিয়েছেন। তিনি সবাইকে সমান গুণ দেননি। এমনকি রিজিকও একেক জনের-“
-‎”রিজিক কি?”
-‎”রিজিক হলো যা কিছু তুমি পাচ্ছ আল্লাহর তরফ থেকে। হতে পারে খাবার কিংবা পরীক্ষার মার্কস। আবার হতে পারে বাতাস কিংবা মানুষের আদর। মানে সবকিছুই। এই রিজিক একেক সময়ে একেক রকম ভাবে দেন আল্লাহ। রিজিক বেশি হোক কি কম, দুটোই আমাদের জন্য পরীক্ষা।”
-‎”পরীক্ষা!”
-‎”হ্যাঁ। পরীক্ষা। যে বেশি পেলো সে ঠিকমত শুকরিয়া জানালো কিনা, আর যে কম পেলো সে মন খারাপ না করে ধৈর্য ধরলো কিনা, এসবেরই পরীক্ষা। বুঝেছো?”
-‎”হুম!”
-‎”কাউকে বেশি কিছু পেতে দেখলে তাই মন খারাপ করা যাবে না। হিংসাও করা যাবে না। বরং তার জন্য ভালো দুআ করতে হবে, যাতে আল্লাহ তাকে তা আরো বাড়িয়ে দেন।”
-‎”বাড়িয়ে দেন!”
-‎”হুম। কেউ যখন আরেক জনের জন্য তার অনুপস্থিতিতে ভালো দুআ করে, তখন ফেরেশতারা তার জন্যও আল্লাহর কাছে দুআ করেন, এই বলে- ‘তোমার জন্যও তাই হোক’!”
-‎”সত্যি!”
-‎”হ্যাঁ, সত্যি!”

আনাসের মুখে হাসি ফুটে এতক্ষণে! হাসতে হাসতেই নিজ মনে কি যেন ভাবতে থাকে। আয়েশা আন্দাজ করে কি হতে পারে, মনে মনে হয়তো দুআর তুবড়ি ছুটিয়েছে সে!

একটু পরই ঘন্টা বেজে ওঠে। আনাসের আর টিফিন খাওয়া হয় না। তবু মনটা তো অন্তত ভালো হয়েছে, একথা ভেবে স্বস্তি পায় আয়েশা। নিজের কাজ গুলোয় এবার মন দেয়। আজ আর ক্লাস নেই, স্কুল ছুটির আগে সব খাতা দেখে শেষ করতে হবে।

স্কুল ছুটির ঘন্টা যখন দিলো, তখন আয়েশা তার শেষ খাতা দেখছিল। মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানিয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়লো। গেটে আবারও দেখা হলো আনাসের সাথে। হাসি মুখে প্রিয় টিচারকে বিদায় জানিয়ে অপেক্ষারত মায়ের কাছে ছুটে গেল সে। আসাদ সেখানে ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে, মায়ের কোলে থাকা ছোট বোনটাকে আদর করছে। আনাসও গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলো।দৃশ্যটা চমৎকার, কিন্তু তা দেখেই আয়েশার বুকটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো। আল্লাহ কাউকে কাউকে কোল ভরে সন্তান দেন বটে- মনে মনে ভাবলো।

হঠাৎ নিজের সম্বিৎ ফিরে পেলো আয়েশা, চট করে তাওবাহ করে নিলো। সেই সাথে দুআ করতেও ভুললো না- “হে আল্লাহ! আপনি তাকে সন্তান সন্তুতিতে আরো বারাকাহ দিন, আর তাদের প্রত্যেককে করুন সঠিক পথের অনুসারী ও চক্ষু শীতলকারী।”

চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাওয়ায় আনাসদের আর দেখতে পেলো না আয়েশা। সে আরও দেখতে পেল না তাদের, যারা সে মুহূর্তে সমস্বরে দুআ করছিলো এই বলে- “তোমার জন্যও তাই হোক! তোমার জন্যও তাই হোক!”

অস্ফুট
-বিনতে আব্দুল্লাহ

(২০/০১/২০১৯)