নষ্টালজিয়া

সাল ২০০৫। তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমার বোনের বেবি হবে, খুব এক্সসাইটেড। কিন্তু ওর প্রেগনেন্সিতে কমপ্লিকেশন্স দেখা দিলো। ব্লাড প্রেসার বেশি, preeclampsia হয়ে যাবে ডাক্তার বললেন। বোনের বেবি হওয়ার সময়ই প্রথম ওই নামটা শুনি। আমাদের সবার মন খারাপ। ডাক্তার বলছেন হয় মা বাঁচবে না হলে বেবি। আমার বোন কেঁদে কেঁদে বলছে ওর বাচ্চাকে বাঁচাতে। আর আমরা চাই দুইজনই বাঁচুক। 

আমি তখন নামাজ কালাম পড়ি না। তবে ইনশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ বাক্যদ্বয় প্রায়ই ইউজ করি। আমার এক ফ্রেন্ড একদিন বলেছিল আমি নাকি শাহরুখ খানের মতো মুসলিম! খুব ইনশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ বলি কিন্তু নামাজ কালাম, পর্দা এইসবের ধার ধারি না। 

যদিও কথাটা তখনও পর্যন্ত আমার কাছে কমপ্লিমেন্ট। শাহরুখ খানের সাথে সাদৃশ্য!! ভাবা যায়! তবে আমার বোনের ওই অবস্থায় আর কোথাও কোনো সাহায্য খুঁজে পাচ্ছিলামনা। মনে হচ্ছিলো সব উপায় বুঝি বন্ধ। কিন্তু শুধু একটা ছাড়া।

আল্লাহকে শর্তারোপ করে কিছু চাওয়া ঠিক না, তবে তখনো পর্যন্ত তা জানি না। আল্লাহ কে বললাম, “প্লিজ আমার বোন আর ওর বাচ্চাটাকে বাঁচায় দেন, আমি কোনোদিনও নামাজ ছাড়বোনা।” এই দোআ চেয়ে হাজার আলস্যেও উঠে গিয়ে নামাজ পড়েছি। ধীরে ধীরে নামাজের প্রতি ভালোবাসা বাড়তে লাগলো।

আলহামদুলিল্লাহ, বোন আর ওর মেয়ে দুইজনই বেঁচে গেলো। ৩২ সপ্তাহে ১ কেজি ৪০০ গ্রাম ওজনের ছিল আমাদের সায়রা। ওর এখন ১২ বছর আলহামদুলিল্লাহ। অনেক ট্যালেন্টেড আর আমাদের চোখের মণি। 

আমি নামাজ পড়তে পড়তে একদিন ভাবছি “আল্লাহু আকবার” এর অর্থ কী? আর “সামিআল্লাহু লিমান হামিদা” “রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ ” এগুলিরই বা কী অর্থ? কোরআনের অংশ তো বুঝতে পারছি অর্থ পড়ে, কিন্তু এসবের অর্থ কী? বিশ্বাসের যে অবস্থাই থাকুক, ধর্ম যে মন্ত্র নির্ভর না এটা বিশ্বাস করতাম আলহামদুলিল্লাহ। তাই ক্লাসের একটা নিকাব পরা মেয়েকে ধরলাম, নাম হুমায়রা। এখন আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ এবং দ্বীনি বোন। 

ওকে আমার সংশয়ের কথা জানাতেই খুব আগ্রহী হয়ে উঠলো। আমাকে বললো, “মাহী, তুমি!!! তুমি জানতে চাও? ” আমি লজ্জিত তবে উৎসুক্য। বললাম, “হ্যা, অবশ্যই। আমি বিশ্বাস করি সব কিছু যা নামাজে পড়ি তার অর্থ আছে। ইসলাম তো মন্ত্র নির্ভর না।” ও খুব খুশি হলো আর পরের দিনই কিছু রিডিং ম্যাটেরিয়ালস নিয়ে আসলো। 

আমি খুব অবাক হলাম। আল্লাহু আকবার অর্থ –
আল্লাহ সর্বশক্তিমান বা সবচেয়ে বড়। সামিআল্লাহু লিমান হামিদা অর্থ – আল্লাহ সেই ব্যক্তির কথা শুনেন যে তাঁর প্রশংসা কীর্তন করে। রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ অর্থ – হে আমাদের প্রভু! তোমার সমস্ত প্রশংসা। 

অর্থাৎ আমরা সরাসরি কমুনিকেট করছি আল্লাহর সাথে। অর্থগুলো জানার পর নামাজের প্রতি আগ্রহ তথা ইসলামের প্রতি আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো। ইতোমধ্যে টি.ভি তে গান, নাচ দেখতে আর ভালো লাগে না। পিস্ টি.ভি তে লেকচার শুনতাম। অনেক মুগ্ধ হয়েছি। বারাকাল্লাহু ফীহ। ইসলামকে ভাবতাম ইসলামিয়াত সাবজেক্টে কিছু নাম্বার পাওয়ার জন্য পড়ার বিষয়। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে জানার যে আরো কত কিছু বাকি তা লেকচার শুনে উপলব্ধি করলাম। 

দেখতে দেখতে সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল চলে আসলো। পড়ার বই থেকে কোরআন পড়তে বেশি ভালো লাগে। আর ছিলাম তো ইকোনমিকসে। ভালো লাগার কোনো বিশেষ কারণ নাই। অবাক লাগতো, মাঝে মধ্যে মনে হতো পুরাটাই ফাঁকাবুলি। আরে ইন্টারেস্ট রেট ০ করে দিলেই ল্যাঠা যায় চুকে। কিন্তু না! ঐ ইন্টারেস্ট রেট নিয়েই পড়ে আছে। কতগুলো প্যারাডক্সিক্যাল কেসও ছিল। 

যাই হোক ফার্স্ট ইয়ারে ১২ নম্বরের জন্য ফার্স্ট ক্লাস আসে নাই। এই বার তো উপায়ই নাই। সেকেন্ড ইয়ার এর ফাইনাল চলছে তখন সায়রা বেবি বাসায় আসলো। পড়ি আর ওর কান্না শুনলেই গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকি। কতদিন আগের কথা, চিন্তা করলে মনে হয় এই তো সেইদিন। 

পরীক্ষা শেষ। রেজাল্ট দিলো। যথারীতি জানতাম ফার্স্ট ক্লাস আমার জন্য না, এবার ব্যবধান ২৯ নম্বর।
থার্ড ইয়ারে প্রথম দিকে বাবা একদিন ডেকে নিয়ে বসালেন। খুব গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কী কোনো পছন্দ আছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “মানে?” বাবা বললেন, “দেখ, তুমি এখন থার্ড ইয়ার এ পড়, আমার অনেক বন্ধুর মেয়েদের দেখেছি মাস্টার্স করার পর আর বর খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই তোমার জন্য এখন থেকেই দেখা স্টার্ট করবো, দেখা শুরু করলেই তো আর পাওয়া যায় না। তোমার অনার্স এর পরই বিয়ে দিব।” 

আমি ইতোমধ্যে চিন্তা ভাবনায় একটু হুজুর টাইপ হয়ে গেছি , বাবা জানেন না। বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নাই তবে ছেলেটা যদি মডার্ন, সেক্যুলার হয় তাহলে আমার চিন্তা ভাবনা বুঝবেও না আর সম্মানও করবে না। কি করে বাবা কে বলবো তাই ভাবছি। 

বলেই ফেললাম, “বাবা, তোমরা আমাকে বিয়ে যেখানে চাও দিবা আমার কোনো আপত্তি নাই। কানা, খোঁড়া কিছুতেই আপত্তি নাই বাট আমার শুধু একটা চাওয়া যেটা তোমাদের ensure করতে হবে।” বাবা জানতে চাইলেন। বললাম, “ছেলেকে অবশ্যই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে। দাঁড়ি , টুপি বলছিনা কারণ আমি বোরখা পড়ি না। তবে আমি নামাজ পড়ি আর চাই সে আমার থেকে বেশি ঈমানদার হোক।” 

আমার চিন্তা ছিল আসলে, যারা নামাজ পড়ে তারা আল্লাহ কে ভয় করে। কোনোদিন খারাপ পথে যাবার সুযোগ কম থাকে। আমার বাবা খুবই খুশি হলেন। স্বাভাবিকভাবেই বাবার মেয়েদের কোনো পছন্দ নাই আর এতো নোবল একটা চাওয়া শুনে খুশি হবেনই। তবে তারা আসলে আমার চাওয়ার depth বুঝেন নি তখনও পর্যন্ত।

যথারীতি একটা “খুব ভালো” প্রস্তাব আসলো। ছেলে ডাবল স্ট্যান্ড, বুয়েট থেকে পড়াশোনা শেষ করে আমেরিকার কোনো এক ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছে। আর পরিবারও আমার বাবার চাহিদা মাফিক। আমার বাবা একজন retired additional secretary তাই স্বভাবতই ছেলের বাবা সরকারি চাকুরে হওয়ায় বাবার আগ্রহের অন্ত ছিলোনা। সব কিছু মিলে যাচ্ছে কিন্তু আমার চাওয়াটা কেন যেন গুরুত্ব পাচ্ছে না! 

আমি প্রতিবার নামাজে সিজদায় কাঁদছি। আল্লাহর কাছে দুআ চাচ্ছি, কোনোভাবে যেন তার সাহায্য পাই। 
আল্লাহর সাহায্য আসলেই নিকটে। আলহামদুলিল্লাহ। একদিন পরেই ছেলের মা এসে দেখে গেলেন। ভদ্রমহিলা বোরখা পড়েন দেখে খুব ভালো লাগলো। আমি ইউনিভার্সিটিতে বাসে যাতায়াত করতাম তাই আম্মুকে বলেছিলাম আমি বোরখা পড়তে চাই, secured feel হয়। কেউ তাকাবেনা, কেউ কথা বলবেনা। কিন্তু আম্মু তখনও ইসলামিক দিক দিয়ে সমঝদার না হওয়ায় আমাকে বলেছিলেন যদি এমন কারো সাথে বিয়ে হয় যে বোরখা পড়তে দিবে না তখন বোরখা খুলে চললে আরো বেশি গুনাহ হবে। যদিও আম্মুকে কিছু বলি নাই তবে দোআ তখন থেকেই জারি ছিল। 

ছেলের মা আরেকদিন আসলেন, সাথে আরেকজন ভদ্রমহিলা কে নিয়ে। আলহামদুলিল্লাহ রমজান মাস ছিল। ওনারা যাবার সময় আম্মু এগিয়ে দিয়ে আসতে বললেন। আমি গেলাম। আমাকে খুবই আদর করে জিজ্ঞেস করলেন, “রোজা রেখেছো মা?” আমি বললাম, “জী।” বললেন, “মাশাআল্লাহ, আমার ছেলেও মাঝে মধ্যে রোজা রাখে।” আমি থমকে গেলাম। মনে মনে খুশি হলাম। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর সাহায্য চলেই এসেছে।

উপরে গিয়ে আম্মুকে বললাম, “যে ছেলে মাঝে মধ্যে রোজা রাখে সে তো নামাজ পরেই না। “আম্মু বললো , “রোজা হয়তো টাইম অনেক বেশি লাগে ওই দেশে তাই রাখে না, নামাজ তো পড়তেই পারে। ” কিন্তু ব্যাপারটা ক্লিয়ার না। 

বড়বোন ছেলের ছবি নিয়ে আসলো। আমি ঠিক মত দেখেছি বলে মনে নাই। বললাম, “আমার এক্সপেকটেশন মিট করে না।” আমার বোন বিশাল লেকচার দিলো। শুনলাম , কিন্তু কথা একটাই প্রমান চাই, অকাট্য প্রমাণ। আমি জানি অনেক বড় ভুল হচ্ছে। সেদিন রাতে আল্লাহর কাছে খুব কাঁদলাম। পরের দিন সকালে একটা ইমেইল পেলাম। USA তে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের মোটামোটি কোনো অভাব নাই, তাই ছেলের খবর নেয়া কোনো ঘটনাই না। ইমেইল থেকে জানতে পারলাম ছেলেটা নাইট ক্লাবে যায়! আর যাই হোক নামাজ না পড়ার এর থেকে ভালো প্রমাণ আর কি হতে পারে। আলহামদুলিল্লাহ। 

আমার বাবা খুবই আহত হলেন। প্রস্তাবটা তার আসলেই অনেক পছন্দ হয়েছিল। ছেলেপক্ষকে অবশ্য আমি বলতে বলেছিলাম আমার ছেলে পছন্দ হয় নি। কিন্তু বলা হলো, “মাস্টার্স এর আগে মেয়ে বিয়ে করবে না।” এ কথা ছেলের মা কে বলতেই তার রিঅ্যাকশন ছিল, “কালো মেয়ের আবার এতো চয়েস কি?” আমি অবশ্য প্রতিটা রিঅ্যাকশনেই আলহামদুলিল্লাহ বলেছি।

এবার আমার মা খুব আহত হলেন। আসলে আমাকে আমার গায়ের রং নিয়ে কেউ কিছু বললে আমার মা কখনোই সহ্য করতেন না। আসলে আল্লাহর কাছে চাওয়া দোআ কখনোই বিফলে যায় না। 

পরবর্তীতে আমার সেই ব্যক্তির সাথে বিয়ে হয়েছিল যাকে আল্লাহ আমার জন্য লিখে রেখেছিলেন। প্রকৃত দ্বীনদার, তাকওয়াবান একজন। 

অতএব, কোন কিছুতেই হতাশ হবেন না। দোআ অব্যাহত রাখুন। যারা অবিবাহিত/বিবাহিত/ চিরকুমার/চিরকুমারী সবাই!

নষ্টালজিয়া
সামান্থা সাবেরিন মাহি
(২১ ডিসেম্বর ২০১৭)