নিয়ামতের গল্প

সকাল থেকে একনাগাড়ে টিপটিপ ব্রিষ্টি পড়ছে, রাস্তাঘাট প্যাঁচ প্যাঁচে হয়ে আছে। চারদিক মেঘলা হয়ে আছে, শেষ পর্যন্ত শীতটা বোধ হয় নেমেই গেলো। এ বছর মনে হয় “উনো বরষা, দুনো শীত নামের খনার বচনটি মিথ্যে প্রমাণিত হবে। 

সকাল সাতটা বেজে গেছে, এখনো তিথি লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কোন কোন দিন তার কিচ্ছুটি করতে ইচ্ছে করে না। সারাদিন ‘আলসে দিবস” উদযাপন করতে ইচ্ছে হয়। আজ তেমন একটি দিন। বিয়ের আগে তার এই আলসে দিবস গুলোতে কেও তাকে বিরক্ত করতো না, মা এসে মুখে তুলে খাইয়ে দিতো, বুয়ারা সব কাজ করে দিতো। এইসব মনে করে, আধা ঘুম জাগরণের মাঝেই তার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। 

ইশ মা কত কষ্টই না করতেন, মায়ের ও নিশ্চয় মাঝে মাঝে অলস পড়ে থাকতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু মুখ ফুটে কখনো বলতেন না। সেই কাকডাকা ভোরে উঠে যেতেন মা। আর ওদের ভাই বোনদের ঘুম ভাঙতো মায়ের সুমধুর তিলাওয়াত এর শব্দ শুনে শুনে, আহা কি সব দিন ছিলো সেসব…

আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লো তিথি, না উঠে যে উপায় নেই, এখন সেও তো একজন মা! এমনিতেই আজ দেরী হয়ে গেছে। রাহাত সকালে নিজে নিজে সিরিয়াল খেয়ে বের হয়ে গিয়েছে। রাতে মাথা ব্যাথা ছিলো, তাই ওকে আর ডাকে নি। 

বরের এই ব্যাপারটা ওর বেশ লাগে, টিপিকাল পুরুষ মানুষদের মতো সারাদিন সার্ভিস ডিমান্ড করে না। বরং সময় পেলে ওকে অনেক সাহায্য করে। বাঙালি পুরুষদের আসলে কয়েক বছরের জন্য হলেও দেশের বাইরে সংসার করা উচিত, তাহলে তারা কাজকর্মে স্ত্রীকে হাত লাগানোকে আর সম্মানহানীকর কাজ মনে করবে না।

যা হোক, বাচ্চাগুলোকে ওঠাতে হবে এখন, শুরু হবে প্রাত্যহিক যুদ্ধের সূচনা। বড়টাকে বাথরুমে পাঠিয়ে চার বছরের ছোটটার পেছনে লাগলো ও। ঘুমের মাঝেই তাকে নাস্তা খাইয়ে স্কুলের ড্রেস পড়িয়ে ফেললো, এরপর সাড়ে পাঁচ বছরের বড় জনের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে, আবিষ্কার করলো, তিনি কমোডে বসে দ্বিতীয় পর্বের ঘুম সেরে নিচ্ছেন!

দুটোকে স্কুলে পাঠাতে পাঠাতে প্রায় আটটা বেজে গেলো এবং দশটা বেজে গেলো, তবুও বুয়া এলো না। হাল্কা পাতলা বৃষ্টি হলেই মহিলা এবসেন্ট করে। তাকে একটা ছাতা কিনে দেয়া হয়েছে, বৃষ্টি হলে রিক্সা করে আসলে, ভাড়া দেবার ওয়াদাও দেয়া হয়েছে। তাও বৃষ্টি বাদলার দিনে কোনভাবেই তার টিকিটির দেখা মিলে না। 

তিথির মেজাজ খারাপ হলেও বুয়াকে কিছু বলে না, কারন নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। তার উপর বাংলাদেশের এই বুয়া সিস্টেমটাও তার খুবই অমানবিক লাগে, কতো অল্প পয়সার বিনিময়ে ওরা খাটিয়ে নেয় দরিদ্র মানুষগুলোকে! উন্নত দেশগুলোতে এভাবে লোক খাটাতে গেলে ফতুর হয়ে যেতে হবে। 

বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর তিথি আর রাহাত অনেক দিন বুয়া রাখেনি, কিন্তু এই দেশে বুয়া না রেখে উপায় নেই, তাই বাধ্য হয়ে ছুটা বুয়া রেখেছে। 

সারাদিন অনেক কাজ করতে হলেও, সে বাঁধা মানুষ রাখে না, একই ঘরে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড তার সহ্য হয় না। তাদের জন্য আলাদা বাসন, আলাদা শোবার যায়গা… এক কথায় তারা যেনো অচ্ছুত সাব হিউম্যান আর নিজেরা যেনো ব্রাহ্মণ শ্রেণীর উচ্চজাতের মানুষ!

প্রথম দিকে শাশুড়ি তাদেরকে বাচ্চা দেখার জন্য একটি ছোট মেয়ে দিয়েছিলেন, তাকে বিছানায় বসতে দিয়েছিলো দেখে তিথিকে কি কথা টাই না শোনালো বড় ভাবী!! আর ছোট ছোট মেয়েগুলো গরীব হয়েছে দেখে, বাবা মাকে ফেলে থাকবে, সারাদিন তার ফুটফরমাশ খাটবে, এসব কোনমতেই মেনে নিতে পারে না তিথি। এইসব নানা কারণে সে ছোট মানুষ রাখা বন্ধ করে দিয়েছে।

শীতের মাঝে গায়ে শাল পেঁচিয়ে সিংকের স্তুপ হয়ে থাকা জিনিসপাতি ধোয়া শুরু করলো, আজ রাতে রাহাতের কিছু বন্ধু আসবে, তাদের জন্য রাঁধতে হবে। বাচ্চাদের জন্য ঝাল ছাড়া মুরগী রাঁধতে হবে। শশুরের জন্য পাতলা করে শোল মাছের ঝোল পাঠাতে হবে, বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছেন তিনি।

এর মাঝে মেঘ কেটে গেছে, মিষ্টি রোদ উঠেছে। সব কাজ সেরে গোসল করে বারান্দায় মাদুর পেতে খবরের কাগজ নিয়ে, শীতের রোদ পোহাতে বসলো সে। সেই সাথে বানিয়ে নিলো এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি।

দিনের এই সময়টা তার খুব প্রিয়। পুরোপুরি নিজের মতোন করে কিছুটা সময় কাটায় সে। আধাঘণ্টা পরেই বাচ্চারা স্কুল থেকে চলে আসবে, হৈ চৈ শোরগোলে ঘর ভরে যাবে। 

হঠাত মন টা ভালো হয়ে গেলো তিথির, নরম রোদে ভেজা চুল শুকাতে শুকাতে তার মনে হলো, জীবন টা আসলে মন্দ নয়। সারাদিনের এই ব্যস্ততা ছুটোছুটিতে মাঝে সাঝে হাঁপিয়ে উঠলেও, এই ব্যস্ততার জন্যই তো জীবন প্রাণ চঞ্চল, সুন্দর। 

ভালোবাসার মানুষদের জন্য কাজ করাতেও তো আনন্দ, তাদের আশে পাশে পাওয়াও তো আল্লাহ্ এর রহমত। এরা তো কেও চিরকাল তার সাথে থাকবে না, একদিন বাচ্চারা বড় হয়ে নিজেরা নীড় রচনা করবে, খালি হয়ে যাবে তার ঘর। তারা বুড়োবুড়ি পরে থাকবে শুধু, একসময় হয়তো তারাও ধীরে ধীরে চলে যাবে অনন্তের পথে….

তিথি অবাক হয়ে উপলব্ধি করলো, সবাই কেনো শুধু ভবিষ্যৎ এর কথা ভাবতে ভাবতে বর্তমান জীবনের ছোট ছোট আনন্দকে অনুভব করে না, জীবনের প্রাপ্তিগুলোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না!

বর্তমানের সমষ্টিতেই তো সুন্দর অতীত সৃষ্টি হয়, কৃতজ্ঞ জীবনই তো ভিত্তি গড়ে পরিতৃপ্ত ভবিষ্যৎ এর! তিথি মনে মনে ঠিক করলো, এখন থেকে প্রতিদিন নিয়ম করে তার সকল নিয়ামতের জন্য সে শুকরিয়া আদায় করবে।

কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়লো ও। একটু পর ওর জীবনের নিয়ামতরা ঘরে চলে আসবে। 

————————
নিয়ামতের গল্প
হাসনীন চৌধুরী 
(১৭ মার্চ ২০১৮)