পুনরাবৃত্তি

সায়মার ঘরে ঢুকতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন আমেনা। দরজার বাইরে থেকেই সায়মাকে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা পেটে হাত রেখে কাঁদছে। আমেনার বড় ছেলের বউ সায়মা। মেয়েটা সাড়ে সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। সায়মার দিকে তাকিয়ে আমেনার ২৫ বছর আগের স্মৃতি হঠাৎ মনে পড়ে গেল।

আমেনাও সায়মার মত বিয়ের পরপর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। অনেক অসুস্থ থাকতেন পুরো সময়টা। ঠিক এমন সাড়ে সাত মাসে তার পেটে বাচ্চার নড়াচড়া খুব কমে গিয়েছিল। একবার হসপিটালে ভর্তিও থাকতে হয়েছিল। অক্সিজেন দিলে বাবু নড়ে, কিন্তু বাসায় আসলে ২/৩ দিনে নড়াচড়া কমে যায়।

সেদিনের কথা আমেনার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। সারারাত বাচ্চাটা নড়েনি। ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর তিনি বলেছিলেন যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেতে, অবস্থা খারাপ হলে ইমার্জেন্সি সিজার করতে হতে পারে। আমেনার হাসবেন্ড তখন অফিসে। তিনি দৌড়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার শাশুড়িকে খবরটা দিয়েছিলেন। রুমে এসে ব্যাগ গুছানোর সময় শাশুড়ি ঘরে এসে ঢুকলেন।

এসেই বললেন, “তাহলে, বাচ্চাটাকে তুমি এতো আগে বের করে ফেলতে চাচ্ছো??”
আমেনা অনেক বড় ধাক্কা খেলেন এই কথা শুনে। তিনি অবাক হয়ে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিন্তু তার মনেহয় সেদিকে খেয়াল ছিল না। তিনি বলতেই লাগলেন, “আরো কয়েকদিন বাচ্চাটা পেটে রাখলে কি হতো? পেট থেকেই বাচ্চাটা হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বের হতো, এতো আগে বের করলে ইনকিউবেটরে রাখা লাগবে। কত খরচ! এতো টাকা কোত্থেকে আসবে??”

আমেনার রাগে দুঃখে সমস্ত শরীর কাঁপছিল! তিনি কি নিজের ইচ্ছায় বাচ্চার নড়াচড়া কমিয়েছেন!! তাও তিনি বোঝানোর চেষ্টা করতে গেলেন, “আম্মা বাবুর নড়াচড়া কম, অক্সিজেনের অভাব…”

পুরো কথা শেষ করার আগেই তিনি রাগের সাথে বলে উঠলেন, “বাচ্চাকে তো সেবার অক্সিজেন দিয়ে তুমিই নষ্ট করেছ, এখন অক্সিজেন ছাড়া আর নড়তেই চায়না। এখন আবার সময়ের আগেই পেট থেকে বের করে ফেলতে চাইছো! আরো দুই সপ্তাহ পেটে রাখলে কি হয়? ডাক্তাররা তো কত কিছুই বলে,তাই বলে তোমাকেও বাচ্চা বের করে ফেলতে হবে নাকি??”

আমেনার এখনো মনে আছে সেদিন তিনি কতটা কষ্ট পেয়েছিলেন। একটা বাচ্চা পেটে রাখা, প্রতিটা মুহূর্ত বাচ্চাকে অনুভব করা, বাচ্চার কষ্ট হচ্ছে কিনা ভেবে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে থাকা, এতো অসুস্থ থাকার পরেও বাচ্চার কথা ভেবে খুশি মনে সব কষ্ট মেনে নেওয়া – যে বাচ্চাকে চোখে দেখেনি সেই সন্তানের প্রতি কী পরিমাণ মায়া জন্মায় তা তো আরেকজন মায়েরই বুঝার কথা। কেউ কি চায় তার বাচ্চাটার সময়ের আগে জন্ম হোক? নাকে অক্সিজেন, মুখে নল, হাতে ক্যানোলা থাকুক?? তারপরেও তো বাচ্চার প্রয়োজনে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

ভাবতে ভাবতে আমেনার চোখে কখন পানি চলে এসেছে তিনি নিজেও বুঝতে পারলেন না। নাহ এবার তিনি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেবেন না। তিনি সায়েমার ঘরে ঢুকে মেয়েটার মাথায় হাত রেখে বললেন, “কী হয়েছে মা, তোমার মন খারাপ কেন?”

বিয়ের নয় মাস হয়ে গেছে, সায়েমা এতোদিনেও শাশুড়ির সাথে সহজ হতে পারেনি। কিন্তু আমেনার এই ভালোবাসার সামান্য মা ডাকে সব ব্যবধান, মনোমালিন্য আজ মুছে গেল। সায়েমা আমেনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল, “মা বাবু না কাল সন্ধ্যা থেকে নড়ছেনা। খুবই সামান্য টের পাই।”

আমেনা সায়েমার চোখ মুছে দিয়ে বললেন, “চিন্তা করো না মা, হায়াতের মালিক আল্লাহ। দুই রাকাত নফল সালাত পড়ে প্রস্তুত হও, আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। তুমি দুশ্চিন্তা করলে বাচ্চার ক্ষতি হবে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো মা। আল্লাহর কাছে চাও সালাতের মাধ্যমে।”

সায়েমা চোখ মুছে আমেনার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো। সে দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা, সম্মান, ভরসা সব ছিলো। সায়মা অজু করতে চলে যাওয়ার পর আমেনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সামান্য একটা কথা, একটু সহানুভূতি যে জীবনের জটিলতা কত দূর করে দিতে পারে তা যদি সবাই বুঝতো!

আমেনার সেবার সিজার করা লাগেনি, বাচ্চা সঠিক সময়েই হয়েছিল আল্লাহর ইচ্ছায়। কিন্তু সেই দিনের পাওয়া কষ্টটা আজও আমেনার চোখ ভিজিয়ে দেয়। এই চোখের পানির ভার কি বহন করার ক্ষমতা আখিরাতে থাকবে জুলুমকারীর?

পুনরাবৃত্তি
উম্মু আসাদুল্লাহ
(৫ ডিসেম্বর ২০১৭)