হজ্জের প্রস্তুতির কিছু জরুরী বিষয় -২

গত পর্বে হজ্জের প্রস্তুতি বিষয়ক কিছু জরুরী বিষয় আলোচনা করা হয়েছিলো। আজ থাকছে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে টিপ্স-

# সব সময় পরিচয়পত্র, মোয়াল্লেম কার্ড, হোটেলের কার্ড, কব্জী বেল্ট সাথে রাখবেন। মনে রাখবেন আপনি হারিয়ে গেলে এগুলোর মাধ্যমে আপনাকে আপনার এজেন্সীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।

# প্রতি ওয়াক্তে জানাযার নামাজ হয়। অনেক মহিলারাই জানাযার নামাজ পারেন না। শিখে নিবেন।

# হজ্জ এর সময় আপনি সারা দুনিয়ার মানুষকে একসাথে দেখতে পাবেন। যেটা আর কোথাও পাবেন না। দেখতে পারবেন নানান মানুষের নানান রকম মত আর নিয়ম কানুন। যদি কেউ কোন ভুল করে তাহলে তাকে সাবধানে ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে বুঝাতে চেষ্টা করুন। কাউকে সরাসরি শুধরানোর চেষ্টা করবেন না। অপর ব্যক্তি না বুঝলে চুপ থাকুন। বিবাদে জড়াবেন না।

# দোয়া কবুল হওয়ার স্থানে মন ভরে দোয়া করুন এবং আগে থেকে ঠিক করে রাখুন কি দোয়া করবেন। অনেক সময় আবেগের কারনে কি দোয়া করবেন তা মনে থাকেনা।

# মন ভরে কাবা ঘর দেখে নিবেন। কারণ আপনি জানেন না যে আপনি আর কোনদিন কাবা দেখতে পারবেন কিনা।

# প্লেনে উঠার আগে থেকেই আপনার হ্যান্ড ব্যাগে পাতলা জায়নামাজ সবসময় সাথে রাখবেন এবং স্প্রে করা যায় এমন পানির বোতল সব সময় সাথে রাখবেন। যাতে অযু করার জায়গা না থাকলে স্প্রে করে হাতের তালুতে পানি নিয়ে অযুর ফরযগুলো আদায় করে অযু করে নিতে পারেন। মালয়শিয়ান ও ইন্দোনেশিয়ানরা এমন করে থাকেন। অযু না থাকলে মসজিদে বসে বা রাস্তা ঘাটে অযু করে নিতে পারেন।

# আপনাকে অনেকক্ষন মসজিদে থাকতে হবে। তাই সাথে খেজুর, বাদাম বা শুকনো খাবার রাখবেন। মনে রাখতে হবে কোন ভাবেই আপনার অসুস্থ হওয়া চলবে না। এমন কোন কাজ করবেন না যাতে আপনি অসুস্থ হয়ে যান। যেমন বেশি উমরা করতে গিয়ে অনেকে এমন অসুস্থ হয়ে যান যে ফরজ কাজ করতে পারেন না।

# শুষ্ক আবহাওয়ায় ডিহাইড্রেশন এড়াতে, প্রচুর পরিমানে পানি ও জুস খেতে হবে।

# কখনোই মসজিদের বাইরে স্যান্ডেল রাখার জায়গায় স্যান্ডেল রাখবেন না। স্যান্ডলের জন্য আলাদা ব্যাগ সাথে রাখবেন।

# আপনি যখন মিনা, মুজদালিফা ও আরাফায় অবস্থান করবেন, তখন চেষ্টা করবেন আপনার ব্যাগের ওজন যেন কম হয়। কারণ অনেক হাঁটতে হবে ও নিজের বয়য়াগ নিজেকেই বহন করতে হবে।

# জামারাতে (পাথর মারার জায়গা) বড় ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দিবে না। ব্যাগ নিয়ে ফেলে দেয় অনেক সময়। সেই ক্ষেত্রে সাবধান।

# ইহরাম অবস্থায় আপনি কোন সুগন্ধি বা সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবেন না। অনেকেই বিভিন্ন লোশন ও সাবান ব্যবহার করেন যা সুগন্ধি যুক্ত। এ ক্ষেত্রে সুগন্ধি ছাড়া লোশন ও ভেসলিন ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু দেশীয় পেট্রোলিয়াম জেলী গুলোতে লেবুর সুগন্ধ থাকে। দেশে সুগন্ধ ছাড়া বল সাবান পাওয়া যায়। তাছাড়া মক্কাতে হারাম শরীফের আশেপাশের দোকানে এক রিয়েলে সুগন্ধি ছাড়া সাবান পাবেন।

# ইহরাম অবস্থায় অনেকেই বাথরুম ব্যবহার করার পর সাবান দিয়ে হাত ধোয় না। যা স্বাস্থ্য সম্মত না। মিনা, মুজদালিফা ও আরফায় বাথরুমে যাওয়ার সময় আগে থেকেই ছোট করে টুকরো করা সুগন্ধি ছাড়া সাবান ও প্লাস্টিক বা পলিথিন নিবেন।

বাথরুমে যে পানির পাইপ থাকে তা প্রায় সময় মাটিতে পড়ে থাকে। পলিথিন দিয়ে পাইপ ধরতে পারেন বা হ্যান্ড গ্লাভস দিয়ে। তবে হ্যান্ড গ্লাভস পরা ও খোলা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই পলিথিনই ভালো। বাথরুমের বাইরে অনেক লোক অপেক্ষা করে থাকে। তাই চেষ্টা করবেন দ্রুত কাজ শেষ করে আসতে।

# আরাফার ময়দানে অনেক নিম গাছ দেখতে পাবেন। ইহরাম অবস্থায় আপনি কোন গাছের ডাল ভাংগতে পারবেন না। কিন্তু অনেকেই গাছের ডাল ভেংগে মেসওয়াক করে। এ ব্যাপারে সাবধান।

# প্রয়োজনীয় ঔষধ সাথে রাখবেন। বিশেষ করে মুভ, প্যারাসিটামল, স্যালাইন, ভেইভ, সেভলন, ভিক্স, ভ্যাসলিন, ভেরালজিন ইত্যাদি। তাছাড়া নিয়মিত কেউ যদি কোন ঔষধ খায় সেগুলো কত দিনের প্যাকেজের জন্য যাচ্ছেন সেই হিসাবে সাথে রাখবেন। প্রয়োজনে অতিরিক্ত কিছু ওষুধ সাথে রাখবেন।

# মদিনায় যখন মসজিদে কুবায় যাবেন, তখন হোটেল থেকে অযু করে যাবেন। কারণ বাসা থেকে অযু করে মসজিদে কুবায় দু’রাকাত নফল নামাজ পড়লে একটা উমরা হজ্জের সোওয়াব পাওয়া যায়।

# জামারাতে যখন পাথর মারা হয় তখন অনেকেরই একটা জোশ চলে আসে। অনেকেই জুতা, স্যান্ডেল, বোতল ছুড়ে মারেন। এটা করা যাবে না। পাথর মারার সময় বিসমিল্লাহ পড়ে পাথর মারতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটি আল্লাহ এর আদেশ মানার একটি অংশ।

# মদীনায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কবর যেদিকে আছে, সেখানে মেয়েদের সব সময় প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। ফযর ও এশার নামাজের পর একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঢুকতে দেয়। মেয়েদের জন্য ২৫ নং গেইট দিয়ে ঢুকলে সব চেয়ে ভালো। বাংলাদেশ সহ সব দেশের মেয়েদের আলাদা আলাদা করে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে দৌড়া-দৌড়ি এবং ধাক্কা ধাক্কি করবেন না। তবে ছেলেদের এমন নিয়ম নেই।

# লাগেজের গায়ে নিজের নাম, পাসপোর্ট নম্বর, মোয়াল্লেম নম্বর, ঠিকানা লিখে রাখলে ভালো। এছাড়া একটা রঙিন ফিতা দিয়ে চিহ্ন দিতে পারেন, যাতে অনেক ভিড়ের মাঝেও আপনার লাগেজ চট করে খুঁজে পেতে পারেন। লাল ফিতা দিবেন না। বেশীরভাগ মানুষ লাল ফিতা ব্যবহার করে থাকেন।

# কি কি জিনিস সাথে নিবেন — ইহরামের কাপড় ছেলেদের কমপক্ষে দুটো সেট,মেয়েদের ইচ্ছামত মেয়েরা নিবে, দু’আর বই, পাসপোর্ট সাইজের ও স্ট্যাম্প সাইজের কয়েকটি ছবি। কারণ ফোনের সিমকার্ড কিনতে হলে ছবি লাগবে। পাসপোর্টের ফটোকপি, সিম কেনার সময় লাগবে।

এছাড়া আয়রন, বিছানার চাদর, স্যান্ডেল অন্তত তিন জোড়া, টাওয়েল, পাথর রাখার জন্য ব্যাগ, মিনায় যাওয়ার জন্য ব্যাগ, ফুলানো বালিশ, জুতা রাখার জন্য ব্যাগ, পাতলা জায়নামাজ, স্কচ টেপ, মার্কার পেন, কলম, কারেকশন পেন, সুগন্ধি ছাড়া সাবান, টয়লেট টিসু, টেবিল টিসু,পলিথিন, সেইফটিপিন, প্লেট, গ্লাস, চামচ,কাপড় শুকানোর জন্য হ্যাংগার, তুলা, দড়ি, কেঁচি, নেইল কাটার, রেজর, কাপড় শুকানোর ক্লিপ, তায়াম্মুমের মাটি, সুই সুতা, সানগ্লাস।

# আরেকটা গুরুত্বপূর্ন জিনিস সাথে থাকতে হবে। সেটা হচ্ছে ধৈর্য। আপনার সামনে এমন সব পরিস্থিতি তৈরী হবে যে ধৈর্য ধরে রাখা খুব কষ্টকর ব্যাপার হয়ে যাবে। কিন্তু কোনোভাবেই ধৈর্যহারা হওয়া যাবে না।

# আপনি মক্কা বা মদিনা যেখানেই থাকুন না কেন, সেখানে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে রাখবেন। কোন কারনে আপনার সংগী বা আপনি হারিয়ে গেলে সেই জায়গায় চলে আসবেন। সংগীদের ফোন নম্বর সাথে রাখবেন।

# যত পারুন তাওয়াফ করবেন। কারণ আপনি সব ইবাদত দুনিয়ার সব জায়গায় করতে পারবেন, কিন্তু তাওয়াফ শুধু কাবাতেই করতে পারবেন। তাওয়াফ করার সময় খেয়াল রাখবেন যাতে হুইল চেয়ারের ধাক্কা না লাগে। সাধারনত দোতালা, তিন তালায় ও ছাদে হুইল চেয়ার দিয়ে তাওয়াফ করা হয়।

# ফরয তাওয়াফের সময় প্রচন্ড ভিড় হবে। ফরয তাওয়াফ দোতালায় বা ছাদে করলে ভিড় একটু কম পাওয়া যায়। কারন সবাই চায় নিচে তাওয়াফ করতে। ফরয তাওয়াফের পর সায়ী করার সময় অনেক ভিড় হবে। তবে তিন বা চার তালাতে সায়ী করার জায়গা আছে। সেখানে ভিড় কম হয়। এছাড়া একদম ছাদেও সায়ী করা যায়। জায়গাটা আগে থেকে দেখে রাখবেন। কারণ জায়গাটার সিঁড়ি পেতে কষ্ট হয়। তাই অনেকেই এটার খবর জানেন না।

# মিনা, মুজদালিফা ও আরাফায় চেষ্টা করবেন দলের সাথে থাকতে। কারন একবার দলছুট হয়ে গেলে, লাখো মানুষের মাঝে দলের লোকদের খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।

# আপনি আপনার বর্তমান আমল আখলাকের কথা চিন্তা করুন এবং হজ্জ পরবর্তী সময়ে আপনি কোন অবস্থায় নিজেকে দেখতে চান, সেটার টার্গেট করে ফেলুন।

আল্লাহ্‌’র সাথে আপনার সম্পর্কটা যেনো আরো পাকাপোক্ত হয়, সেই ফিলিংসটাকে জাগ্রত করুন। প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন লোক হজ্জে যান। হজ্জ থেকে ফিরে আসার পরেও বেশিরভাগ মানুষের মাঝে আমল আখলাকের কোনো পরিবর্তন হয় না। এটা একটা ভয়ংকর ব্যাপার।

# হজ্জের মূল দিন হচ্ছে আরাফাতের দিন। যেহেতু আপনি হজ্জ করতে যাবেন, তাই এই দিনটির জন্য আগাম প্রস্তুতি নিন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হজ্জ হচ্ছে আরাফাত। অর্থাৎ আপনার আরাফাতের দিন মিস হয়ে গেলে, আপনার হজ্জ হবে না। আপনি যখন আরাফাতের ময়দানে যাবেন, তখন সব মিলিয়ে হাতে ফ্রি সময় পাবেন মাত্র ৬/৭ ঘন্টা।

মাত্র এই কয়েক ঘন্টার জন্যই কিন্তু আপনি এত টাকা খরচ করে যাচ্ছেন। এই কয়েক ঘন্টা আপনি কিভাবে কাটাবেন সেটার প্ল্যান তাই আগে থেকেই করে রাখুন। কারণ এই সময়টা আপনার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। আমি সেখানে মানুষকে ঘুমাতে দেখেছি, আড্ডা আর পরচর্চা করতে দেখেছি, খাবার নিয়ে বাকবিতণ্ডা আর হুড়োহুড়ি করতে দেখেছি, নামায কছর করে পড়তে হবে নাকি হবে না এসব নিয়ে বাকবিতণ্ডা করতে দেখেছি। প্লিজ এসব করবেন না, আপনার হজ্জকে বরবাদ করবেন না।

আশা করি আমার টিপসগূলো সবার কাজে আসবে ইন শা আল্লাহ। সবাই চেষ্টা করুন কম বয়সে হজ্জ করে আসতে। কারণ হজ্জ করতে অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়। কম বয়সে হজ্জ করলে কষ্ট কম হয়। আমাদের দেশের ভ্রান্ত ধারনা হলো যে শেষ বয়সে সব গুনাহর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিবো,আরো একটু বয়স হোক তারপর যাই, ছেলে মেয়ে ছোট, তারা এখনো মানুষ হয়নি, কার কাছে বাচ্চা রেখে যাবো ইত্যাদি কথা বলে অনেকেই হজ্জে যান না।

যারা এসব বলেন তাদের কে বলি, দয়া করে অর্থ, সম্পদ ও শরীর ঠিক থাকতে থাকতে হজ্জ করে আসুন। কারণ আপনি জানেন না, হয়তো এক সময় আপনার অর্থ থাকলেও আপনার স্বাস্থ্য থাকবে না অথবা স্বাস্থ্য থাকলেও অর্থ নাও থাকতে পারে। আর হজ্জ ফরযের পর হজ্জ না করে মারা গেলে, সেই মৃত্যু যেনো ইহুদি নাসারা হয়ে মৃত্যুর সমান। আর আপনি যদি ইচ্ছা করেন যে, যত যাই হোক আমি হজ্জে যাবো এবং আল্লাহর সাহায্য চান তাহলে ইন শা আল্লাহ, আল্লাহ আপনার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে দিয়ে হজ্জ পালনের ব্যবস্থা করে দিবেন।

পরিশেষে আমি সবার কাছে দোয়া চাইছি আল্লাহ যেন প্রতি বছর আমাকে আমার পরিবার পরিজন সহ তাঁর ঘর দেখার সৌভাগ্য দান করেন। আমিন।

————————
হজ্জের প্রস্তুতির কিছু জরুরী বিষয় -২

তাহনিয়া ইসলাম খান

প্রথম পর্বের লিংক:

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=332766790594060&id=209123022958438